বৃহস্পতিবার, ২৯ ডিসেম্বর, ২০১৬

আহা জীবন

আহা জীবন! কত স্বাদ বেঁচে থাকার। আমিও আছি একরকম।
আচ্ছা ও কি জানে আমি কখন কিভাবে বেঁচে থাকি? কতবার কিভাবে মরেছি? জানে না বোধয়। ও শুধু জানে আদর, যত্ন আর ভালবাসা। প্রেম, ব্যাপারটা কি ও ঠিকঠাক বোঝে? আমিই কি বুঝি?
গতপরশু খুব মন খারাপ ছিল আমার, ও বারবার জানতে চাইল কেন মন খারাপ? আমি বোঝাতেই পারলাম না যে কারণ আমার জানা নেই। শেষমেশ ওরও মন খারাপ হয়ে গেল। বুঝতেই পারল না আমার কেন যে মন খারাপ তা যদি আমি জানতাম তাহলে ওকে বলতাম। ওর চেয়ে ভালো আর কে বাসে আমাকে?
ওর বুকের মধ্যে মুখ গুজে দিলে একটা সুন্দর গন্ধ পাই। একটা স্বর্গীয় সুখ। আহা এই তো জীবন। এভাবেই বাঁচতে চাই।
প্রথম যেদিন ওর ঠোঁট আমার ঠোঁটকে ছুঁয়ে গেল মনে হোল যেন নিজেই নিজের ঠোঁট ছুঁয়ে দিলাম। ওটা যেন আমারি ঠোঁট। ও যদি আমার হয় তাহলে ওর ঠোঁট কেন আমার হবে না। সেই উষ্ণ কোমল ঠোঁট আমি শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত মনে রাখব।
সিগারেট খেয়ে ওর সামনে গেলে চোখের দিকে তাকাতে পারি না আমি। মায়াবী চোখ দুটি অবুঝ প্রশ্ন ছুড়ে দেয় আমার দিকে - কেন? কি যে অস্বস্তিতে পরে যাই আমি।
ওকে জড়িয়ে ধরে একটা জীবন কাটিয়ে দেওয়ার মত কাল্পনিক ভাবনা আমি ভাবি না, পাশাপাশি দাড়িয়ে লড়ে যেতে চাই একসাথে। বাঁচতে চাই একটা জীবন।
বিধি বাম। আদমের মত আমার কপালেও স্বর্গসুখ সইলো না। আজ ও চলে যাচ্ছে, আবার দেখা হবে কিনা জানি না।

বুধবার, ২৮ ডিসেম্বর, ২০১৬

সেলসম্যান

এদিক ওদিক তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করলাম কজনের চোখে পড়েছে ব্যাপারটা।
রিক্সাটার জন্যেই যত গণ্ডগোল। ভাবলাম রিক্সাটা আসতে আসতে আমি রাস্তা পার হয়ে যাব। বুঝতেই পারিনি ওটার পেছনেযে মোটর লাগানো আছে। এই এক যন্ত্রণা হয়েছে আজকাল, একে একে রিক্সাগুলোকে ধরে ধরে মোটর লাগিয়ে দেওয়া হচ্ছে। অনেকটা কচ্ছপের পেছনে মোটর লাগিয়ে দেওয়ার মত ব্যপার!
যখন বুঝলাম ওটা মোটর লাগানো রিক্সা গতি বেশি তখন দ্রুত পার হতে গিয়ে হুড়মুড় করে গিয়ে পরলাম একটা অটোর (ইজি বাইক) সামনে। মনে হয় পূর্বপুরুষের পুণ্য ছিল তাই অটোটা ব্রেক কষল। ধপাস করে সামনের গ্লাসে একটা ধাক্কা খেয়ে রাস্তায় পড়লাম।
কয়েক মুহূর্তের মৃত্যুভয় তারপর অটোওয়ালার বকা শুনতে শুনতে উঠে রাস্তা পার হলাম। গালিগালাজ করেনি সম্ভবত পরনের পোশাগুলোর জন্য। সভ্য দুনিয়ায় মানুষের ওজন বাড়ানো-কমানোর ক্ষেত্রে পোশাক একটা বড় ভূমিকা রাখে।
বেশি কিছু হয়নি, বাঁহাতের আস্তিনের দিকে কিছুটা ছিঁড়ে গেছে। চামড়াও ছড়ে গেছে কিছুটা। জ্বলছে। 


ছেঁড়া শার্ট নিয়ে ঘুরে বেড়ানোটা খুব বিরক্তিকর। চাইলে এখনি বাড়ি গিয়ে বদলে আসতে পারি কিন্তু তাতে অনেক দেরি হয়ে যাব। হাতাটা গুটিয়ে এভাবেই যেতে হবে।
স্কুলে এসব নিয়ে খুব বায়না করতাম। পোশাক পরিষ্কার আর ইস্ত্রি করা না হলে আমি পড়তাম না। এখন তো আর সেসব দিন নেই। টাকা যখন পায়ের শেকল হয়ে যায় তখন রুচিবোধ বদলাতে বাধ্য।
কোন একটা ডিসপেনসারি থেকে হাতটা একটু পরিষ্কার করিয়ে নেবো। ওষুধ লাগবে না, অযথা টাকার গচ্চা। দূর্বাঘাসের রস দেওয়া যেতে পারতো। কিন্তু এই শহরে দূর্বাঘাস পাওয়া যায় নির্দিষ্ট কয়েকটা যায়গায়। তার উপর ওগুলোতে ধুলোর প্রলেপ তো থাকবেই। ওসব ভেষজ চিন্তা বাদ দেওয়াই ভালো এটা ধুলোর যুগ।

দোকানদাররা এমনিই সেলসম্যানদেরকে খুব ভালো চোখে দেখে না, তার উপর আজ আবার ছেঁড়া শার্ট! খুব খেয়াল করেছি ভালো পোশাক, সুন্দর করে আঁচড়ানো চুল, ক্লিন শেভড মুখ, চকচকে জুতা, হাতে ভালো একটা ঘড়ি এসব থাকলে বেশি অর্ডার পাওয়া যায়। চাকরীর শুরুতে কিছুদিন বন্ধুদের কাছথেকে এসব ধার করে পরে দেখেছি। অবশ্য এটা ছাড়া আর কোন রাস্তাও ছিল না, চাকরীটা পাকা করার জন্য তখন এই কৌশলটা খুব দরকার ছিল।

পরপর কিছুদিন অর্ডার খারাপ হলে ছাঁটাই করে দিতে কোম্পানি দুবার ভাববে না। এসব চাকরীর কোন ভরসা নেই। এই অবস্থায় চাকরীটা গেলে রাস্তায় গিয়ে দাঁড়াতে হবে। ভাগ্যিস এক্সিডেন্টটা গুরুতর হয়নি, হলে হাসপাতালের খরচ কি করে দিতাম? ভাবতেই গাটা শিউড়ে উঠছে। মরে গেলে অবশ্য বেঁচে যেতাম।
সাধারণত অন্য কিছু করার সুযোগ না থাকলেই কেউ সেলসম্যান হিসেবে কাজ করে। আমিও ব্যতিক্রম নই। ছোটবেলায় স্বপ্ন দেখতাম ব্যাংকার হবো। তা তো আর হল না।তাই... জীবনের তাগিদে অল্প কিছু টাকার জন্যে আমি বেঁচে দিলাম আমার স্বপ্ন, রুচিবোধ আর ব্যাক্তিত্ব।

শনিবার, ১৭ ডিসেম্বর, ২০১৬

জন্মাষ্টমী ~ প্রসেঞ্জিত বোস

আজ রাত্রেই মেয়েটি জন্মায়। গোকুলে ও গোপনে। তার মা তখন প্রসব-পীড়ায় অচেতন। কিছুক্ষণ পর যমুনার ওপার থেকে একটি লোক আসে। নিজের সদ্যোজাত ছেলেটিকে গচ্ছিত রেখে চুপিচুপি মেয়েটিকে তুলে নেয়। মায়ের মুখটি ভাল করে দেখার আগেই জন্মের মতো পরিবার-হারা হয় সেই মেয়ে।

মেয়েটিকে পাচার করা হয় মথুরার এক ঘুপচি কারাগারে। ছেলেটির প্রাণ মূল্যবান। তার প্রক্সি হিসেবে মেয়েটিকে রেখে দেওয়া হয়। মথুরার রাজা ছেলেটিকে মারতে এসে মেয়েটিকে পায় ও তাকেই নিয়ে যায়। মেয়েটি দ্বিতীয় বার হাতবদল হয়।

রাজা যখন পাথরের দেওয়ালে আছাড় মারতে যাচ্ছে কয়েক-ঘণ্টা-আগে-জন্মানো পুঁচকে মেয়েটিকে, হাত পিছলে ছিটকে যায় সে। তারপর কোনও এক অজানা ঘটনা-পরম্পরায় তার ঠাঁই হয় দুর্গম বিন্ধ্য পর্বতে। সেখানেই সে বড় হয়।

মেয়েটির মা-বাবার কাছে ছেলেটিও বড় হয়। একটা সময়ে সেই মা-বাবা সত্যিটা জানতে পারে। ছেলেটি মথুরায় আসল মা-বাবার কাছে ফেরৎ যায়। কিন্তু মেয়েটির মা-বাবা ভুলেও হারানো মেয়ের খোঁজ করে না। কী লাভ খুঁজে ? হারানো, চুরি-যাওয়া, বিক্রি-হয়ে-যাওয়া, পাচার-হয়ে-যাওয়া ছেলেদের ঘরে তোলা যায়। মেয়েদের যায় না।

ছেলেটির এখন দু-জোড়া মা-বাবা। তার জীবনে অনেক প্রেম আসে। অনেক স্ত্রী আসে। অনেক সন্তান আসে। আসে রাজত্ব।

মেয়েটির ? কেউ জানে না। তার এক-জোড়া মা-বাবা, একটি প্রেমিক, একটি স্বামী, একটি সন্তান, একটুও ভূমি জুটেছিল কিনা, কেউ খোঁজ রাখেনি।

একটি ছেলে-বাচ্চাকে বাঁচাতে প্রক্সি হয়েছিল সে, এই তার একমাত্র পরিচয়।

শুভ জন্মাষ্টমী। শুধু কৃষ্ণের নয়, আজ যোগমায়ারও জন্মরাত।

শুক্রবার, ১৬ ডিসেম্বর, ২০১৬

মিশ্রণ - ৫

১) খুব ভালো চকলেট খেলে অনেকক্ষণ স্বাদটা মুখে লেগে থাকে, তেমনি খুব ভালো সিনেমা দেখলে অনেকক্ষণ স্বাদটা মনে লেগে থাকে। কিছুদিন আগে তেমনি একটা সিমেনা দেখার সুযোগ হোল। বাজিরাও মাস্তানি, আহা! কি চমৎকার কাজ, a work of art. যেমন দৃশ্যায়ন, তেমন সঙ্গীত, সেই অনুযায়ী অভিনয়। যদিও অভিনয়ের দিক থেকে আমি মাস্তানি অর্থাৎ দীপিকাকেই এগিয়ে রাখবো।মিঃ বনশালি তার কাজের মান অটুট রেখেছেন বলতে হবে। একটা কথা না বললেই না, প্রিয়াঙ্কা মুখ্য চরিত্রে না থাকলেও তার চরিত্রটার একটা আলাদা গুরুত্ব ছিল, সেই যায়গাতে প্রিয়াঙ্কা একশতে একশ, অভিজ্ঞতার একটা আলাদা মূল্য তো আছে।
ঘটনা বর্ণনা বা সমালোচনায় যাব না শুধু বলবো - আফসোস হয়েছে এতো দেরি করে দেখার জন্যে।
২) একটা ডকুমেন্টারি দেখলাম কিছুদিন আগে, সৌদি আরবের উপর। এর বিভিন্ন অংশ গোপনে ধারণ করা হয়েছে। বিভিন্ন বিষয় উঠে এসেছে এতে, বেশ কয়েকটি আগে জানলেও কিছু বিষয় জানতাম না। মোটকথা বলা যায় - অনেকেরই জীবন সেখানে দুর্বিষহ, কেউ মুক্তির অপেক্ষায়, কেউ মৃত্যুর!
৩) আমার সমস্যা হোল এক যায়গায় স্থির থাকতে পারি না। বই পড়ার সময়ও তাই। এই বই কিছুতা পরে রেখে দিয়ে অন্য একটা নিয়ে বসলাম, সেটা কিছুটা পরে তারপর আবার অন্য একটা তারপর হয়তো আবার প্রথমটায় ফেরত গেলাম! এভাবে কিছু বই গুলিয়ে-মিলিয়ে পড়া হয় আবার কিছু বই শেষকরা হয়ে ওঠে না।
আজকাল যেগুলো নিয়ে আছেঃ
# মন্টেজুমার মেয়ে (দ্বিতীয়বারের মতো পড়ছি)
# চাপড় ঘণ্ট (একটু বাকি আছে)
# পিন্‌ডিদার গপ্‌পো (কিছুটা পড়েছি)
# রবীন্দ্রনাথ এখানে কখনও খেতে আসেন নি (একটু বাকি আছে)
# ঋভু (কিছুটা পড়েছি)
# রাধাকৃষ্ণ (পড়ছি, শেষ করবোই)

বুধবার, ৭ ডিসেম্বর, ২০১৬

রাবণের গুণ

রামায়ণ মহাকাব্যে রামের মেলা গুণ – রাজপুরুষত্বম, ধর্মপরায়ণ, বীর, ধীর, সুসভ্য, সুকান্ত, জ্ঞানী, গুণী ইত্যাদি আর রাবণ তার উল্টো বিকলাঙ্গ (দশমুণ্ড), স্বৈরাচারী, অসভ্য, রাক্ষস, কামুক ইত্যাদি। কিন্তু এমন প্রশ্ন মনে আসতেই পারে যে, রামায়ণের রচয়েতা বাল্মীকি (বা যেই হোক) এর আর্যপ্রীতি ও অনার্যবিদ্বেষের কারনেই কি রামকে নায়ক আর রাবণকে ভিলেন হিসেবে দেখান হয়েছে? কারন ঘটনা বর্ণনার নানা ফাঁকফোকর দিয়ে রাবণের কৌলিন্য, শৌর্য-বীর্য ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রকাশ দেখতে পাওয়া যায়; যার ঔজ্জ্বল্য রামের উজ্জ্বলতার চেয়ে বহুগুণ বেশী।

রাম ছিলেন ক্ষত্রিয়, চার বর্ণের দ্বিতীয় বর্ণের মানুষ। সেকালের ক্ষত্রিয়রা ছিলো বংশগত যোদ্ধা, অর্থাৎ নরঘাতক। অন্যদিকে রাবণের দাদা পুলস্ত্য ছিলেন ব্ৰহ্মার মানসপুত্র এবং স্বনামধন্য ঋষি, পিতা বিশ্ৰবাও ছিলেন একজন বিশিষ্ট ঋষি। ঋষি মাত্রেই ব্রাহ্মণ। ব্রাহ্মণ-এর সাধারণ সংজ্ঞা হলো – ব্রহ্মাংশে জন্ম যার, অথবা বেদ জানে যে, কিংবা বেদ অধ্যয়ন করে যে, নতুবা ব্রহ্মের উপাসনা করে যে। রাবণ গুণগত না হলেও কুলগত ব্ৰাহ্মণ ছিলেন নিশ্চয়ই।

রাবণের রাজমহলকে (কখনো লঙ্কাকেও) বলা হয়েছে ‘স্বর্ণপুরী, তার প্রমোদ উদ্যান অশোক কাননে ছিল বহু বৃক্ষের সমাহার। এতে রাবণের ঐশ্বর্য, শিল্প-নিপুণতা, সৌন্দর্যপ্রিয়তা, রুচিবোধ, বৃক্ষপ্রেম ইত্যাদি বহু গুণের পরিচয় মেলে। কিন্তু রামের ক্ষেত্রে এমন কিছুর উল্লেখ দেখা যায় না।

রাম লঙ্কায় পৌঁছতে বহু লোকের সাহায্য নিয়ে – দীর্ঘ সময় নিয়ে সেতু নির্মাণ করেছিল আর রাবণ প্রযুক্তিতে এতই উন্নত ছিল যে, পুষ্পক নামের রথ ব্যবহার করে অল্প সময়েই পৌঁছে গিয়েছিল। রাম যুদ্ধ করেছে তীর-ধনুক নিয়ে আর রাবণ ব্যবহার করেছেন শক্তিশেল।

ব্রাহ্মন বংশীয় রাবণকে নরখাদক বলা হলেও তার কোন প্রমান মেলেনি অপরদিকে রামের আঘাতে মৃত্যু পথযাত্রী হয়েও রামকে রাজনৈতিক উপদেশ দিয়ে রাবণ উদারতার পরিচয়ই দিয়ে গেছে।

রামের সংসারজীবনে ৫২ বছরে কোন সন্তানাদি হয়নি যদিও সীতা বন্ধা ছিলো না, তার প্রমাণ – কুশ ও লব। এদিক থেকে রামকে ফিজিক্যালি আনফিট বলা যেতে পারে।

রাম তার জন্য সর্বস্ব ত্যাগ করা সীতাকে ত্যাগ করেছিল প্রজাদের খুশি করার জন্য তাও আবার দুই যুগেরও বেশি সময় পরে। অপরদিকে অদেবতা অষ্টম এডওয়ার্ড এর কথাই ধরুন, প্রেমিকার জন্য সিংহাসন ছেড়ে দিয়েছিলেন।

রাবণকে বলা হয়েছে দশানন (দশ মাথাওয়ালা), সম্ভবত সে দশ জনের সমান বুদ্ধি রাখত বলেই (বাস্তবে দশ মাথাওয়ালা নয়)। আর রাম…

* * * * * * * * * *
কৃতজ্ঞতাঃ আরজ আলী মাতুব্বর

বৃহস্পতিবার, ২৪ নভেম্বর, ২০১৬

আলুনামা

আপনি যদি আলু ভক্ত হয়ে থাকেন তাহলে একটা ধন্যবাদ দিন ইনকাদের। কারণ ওরাই পৃথিবীর প্রথম আলু উৎপাদনকারী জাতি। আরেকটু গোঁড়া থেকে বলি, ধারণা করা হয় ১১০০-১২০০ খ্রিষ্টাব্দের দিকে ইনকারা বেরিং প্রণালী পার হয়ে এশিয়া থেকে দক্ষিণ আমেরিকার অন্দিজ পর্বতমালার পেরুর উচ্চভূমির দিকে চলে আসে এবং সেখানে "আলু" সহ আরও অন্যান্য কৃষিজ পন্য উৎপাদন করে, লামা পুষে বসবাস শুরু করে।

ইনকারা ছিল আলুর একনিষ্ঠ ভক্ত। ওদের ঝোলে-ঝালে-অম্বলে সবকিছুতেই আলু। হজমের সুবিধার জন্য সব খাবারেই আলু, হাড় ভাংলে আলুর রস, বাতের ওষুধ হিসেবে আলু, সময় পর্যন্ত মাপত আলুর ফলন দেখে (দেখ কাণ্ড!)।

গোড়াপত্তনের তিনশ বছর পরে স্প্যানিশরা লুটপাট শুরু করে ইনকাদের। মানে স্প্যানিশরা পৃথিবীর দ্বিতীয় জাতি যারা আলু চোখে দেখে, স্বাদ নেয় আর চাষবাস করে। ওদের হাত ধরেই আলু পৌঁছে সাড়া ইউরোপে। প্রথম দিকে ভাবা হতো আলু শারীরিক উত্তেজনা বাড়ায়, যদিও পরবর্তীতে আলু তার নিজ গুণেই লোকেদের ভুল ভাঙায়। শুধু যে ভুল ভাঙিয়েই খান্ত হয়েছে তা নয় স্প্যানিশ সেনাবাহিনীর খাদ্য তালিকাতেও যায়গা করে নিয়েছিল অনায়াসে, স্প্যানিশ সেনাবাহিনী তখন পুরো ইউরোপে ছড়িয়ে আছে; ব্যস আর কি, আলু সেনাদের ঘাড়ে চেপে ছড়িয়ে গেল পুরো ইউরোপে।

জার্মানির রাজা ফ্রেডরিখ উইলিয়াম আলু খেয়ে এমনই ভক্ত হোল আলুর যে সকল প্রজাদের আদেশ দিল আলু চাষ করে খেতে, না করলে নাক কাটা যাবে! ব্যস জার্মান দখলও শেষ।

প্রথম বার আলু দেখে রানি প্রথম এলিজাবেথের বাবুর্চি ভীষণ ঘাবড়ে গিয়ে আলুর গাছটা রেখে আলুকে আবর্জনা মনে করে ফেলে দিয়েছিল!

উইকিপিডিয়া জানাচ্ছে – “পৃথিবীর খাদ্য হিসেবে সর্বপ্রথম আলুর নির্দশন ভারতের বাংলায় দেখা যায়। পালযুগের কবি সন্ধ্যাকর নন্দীর (আনুমানিক ১০৮৪-১১৫৫) রামচরিতে বারাহী কন্দের উল্লেখ আছে। এই বারাহী কন্দ হল উচ্চমানের আলু, রতিকান্ত্র ত্রিপাঠী জানাচ্ছেন "প্রাচীন বাংলার শিলা ও তাম্রলিপিতে সমাজ ও সংস্কৃতি" বইটিতে।” এই তথ্য ঠিক থাকলে বলা যায় বাংলার মানুষজন ইনকাদের কাছাকাছি সময়ে অথবা আগেই আলুর চাষবাস শুরু করে। যদিও এডওয়ার্ড টেরি লিখেছেন – “ব্রিটিশ রাজদূত স্যর টমাস রো’র সম্মানে ১৬৭৫ সালে আসফ খান আজমেঢ়ে যে ভোজসভার আয়োজন করেছিলেন, তাতে আলু পরিবেশিত হয়েছিল।”

এটি পৃথিবীর চতুর্থ বৃহত্তম খাদ্যশস্য, জাতিসংঘ এফএও-এর রিপোর্ট অনুযায়ী একজন মানুষ প্রতিবছর প্রায় ৩৩ কেজি আলু খায় (আমার বেশি লাগে)।

"জাবতক রহেগা সমোছেমে আলু, ম্যা তেরা রাহুঙ্গা ও মেরে শালু" এই গানটা ছাড়া আলু নিয়ে কি আরও কোন গান আছে?

**********
কৃতজ্ঞতা - উইকিপিডিয়া, বাংলাপিডিয়া, আনন্দবাজার , অনুশীলন

বৃহস্পতিবার, ২২ সেপ্টেম্বর, ২০১৬

মিশ্রণ - ৪

১) "সন্ত" উপাধি দেওয়া হলো মাদার টেরেসাকে; আপনার কি জানা আছে তিনি ঠিক কি ধরণের সমাজ ব্যবস্থা চাইতেন? এ প্রশ্ন করার উদ্দেশ্য, দরিদ্রের সেবার চাইতে দারিদ্রের কারণগুলোকে নির্মূল করা অধিক গুরুত্বপূর্ণ

২) যে পনেরটি বাংলা (কলকাতার) সিনেমা আপনার অবশ্যই দেখা উচিৎ। লিস্টটা আমি করলে অবশ্য আরও বড় হতো।

৩) অ্যাজটেক সভ্যতার চেয়েও অক্সফোর্ড বেশি পুরোনো, বিশ্বাস হচ্ছে না?

৪)
 ঈদের ছুটিতে নেট সংযোগের বাইরে ছিলাম তাই স্টকের সিনেমা দেখে কাটিয়ে দিলাম। মহেঞ্জোদারো সিনেমাটি দেখা হয়েছে কি? হলে ভালো না হলে দেখে নেবেন। মহেঞ্জোদারো সম্পর্কে তথ্য পাবেন এখানেসিন্ধু সভ্যতার বৃহত্তম নগরী এটি। সিনেমাটিতে যেমন স্নানাগার দেখেছেন তেমন একটি মহাস্নানাগার সত্যিই ওখানে ছিল, এর রহস্যময়তা সম্পর্কে জানুন এখানে

সিন্ধু সভ্যতার খবর এখানে পাবেনসিন্ধু আর হরপ্পায় গুলাচ্ছেন নাতো? অবক্ষয়ের ফলে এই সভ্যতাটি পতনের দিকে যাচ্ছিল কিন্তু চূড়ান্ত পতন ঘটে আর্য-আক্রমণের ফলে। এবার যদি আপনার সিন্ধু আর বৈদিক সভ্যতা নিয়ে জানতে ইচ্ছে করে তাহলে এই পুরো অধ্যায়টি পড়ে ফেলতে পারেন।  

৫)
ঈদুল আযহায় ঢাকা

৬) মার্গারিটা মামুন সম্পর্কে এদেশের সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহারকারীদের একাংশের মতামত! 

৭) হিংস্র সিনেমা - গেম, উত্তেজক গান, যুদ্ধ জয়ের খবর ইত্যাদির ভেতর দিয়ে আমরা কোন দিকে যাচ্ছি? 

মঙ্গলবার, ২০ সেপ্টেম্বর, ২০১৬

টিভি সিরিয়াল

কলকাতার সিরিয়াল নিয়ে অনেক লেখালেখি দেখেছি ফেসবুকে, এখনো মাঝে মাঝে চোখে পরে, পত্রপত্রিকায় দেখেছি বহুবার, অনেককে এবিষয়ে কথা বলতে শুনেছি। সবাই মোটামুটি একমত – এসব বন্ধ করা উচিৎ; কারণ এগুলো সাংস্কৃতিক আগ্রাসন। বেশ, বন্ধ করা যেতেই পারে। কিন্তু এগুলোর পরিবর্তে আমরা এদেশের বিশাল সংখ্যক টিভি সিরিয়ালের দর্শককে কি দেবো?

কলকাতার সিরিয়ালের দর্শক মূলত এদেশের মেয়ে এবং মহিলারা। পুরুষের তুলনায় তাদের পৃথিবী ছোট। একজন পুরুষের সুযোগ আছে যে কোন সময় বাইরে থেকে ঘুরে আসার, আড্ডা দিয়ে আসার অথবা বনোদিত হওয়ার কিন্তু নারীর তা নেই। নারীদের জন্যে আমাদের সমাজে অনেক নিয়ম-কানুন। তাই বলে কি তাদের বিনোদন থেকে বঞ্চিত করে রাখা যাবে? বিনোদন তো তাদের অধিকার। সম্ভবত এদেশের নারীদের সিংহভাগেরই বিনোদন হিসেবে প্রথম পছন্দ টিভি সিরিয়াল।

কলকাতার সিরিয়াল বন্ধ করে দেওয়া কোন কঠিন ব্যপার নয়। শুধু নির্দিষ্ট চ্যানেলগুলোর আমদানি বন্ধ করে দিলেই হোল। পরিবর্তে কি দেওয়া হবে? এদেশে তৈরি করা নাটক? আমাদের নাটকগুলো সাধারন দুই ধরণের – হয় আমি আর তুমি কেন্দ্রিক পেঁনপেঁনে প্রেম নাহয় রগরগে ভাঁড়ামি। এগুলোও কি মানসম্পন্ন? ভালো নাটক যে হচ্ছে না তা নয় কিন্তু সংখ্যায় কম।

বোম্বাই সংস্কৃতির প্রভাবে প্রভাবিত কলকাতার সিরিয়ালগুলোকে সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের কথা বলে বন্ধ করা যতটা জরুরী তার থেকেও বেশি জরুরী ভালো মানের নাটক এদেশে তৈরি করা।    

বৃহস্পতিবার, ৮ সেপ্টেম্বর, ২০১৬

রসের খোঁজে

আমি কষালো। তাই একটা রম্য বই খুঁজছিলাম, খুঁজতে খুঁজতে শেষমেশ হাঁপিয়ে উঠলাম। শহরের কোথাও জুতসই একটা রম্যের বই পাওয়া গেলো না। রম্যের বই নেই, পত্রিকায় রম্যের লেখা নেই যা আছে তার অধিকাংশই যাতা, টিভিতে রম্যের নামে ভাঁড়ামির ছড়াছড়ি। সব মিলিয়ে রসবোধ প্রায় উঠে যাবার যোগাড়। রসের নামে যা বিকচ্ছে তার অধিকাংশই রগরগে।

একটু রসের জন্যে আমি হাপিত্তেশ করে মরছি। চাকরির নামে মাসমজুরি করছি, আড্ডা দেই ফ্রাস্টেশনের বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়ে, বেঁচে থাকার জন্য খাই, শরীর ক্লান্ত হলে ঘুমাতে যাই। ব্যস এই হচ্ছে আমার জীবন। যাতে শুধু কষ আর কষ। কষালো জীবন! তাই কিছুটা রসালো করতেই রম্যের খোঁজ।

আমার মতোই জীবনের স্বাদ না পেয়ে এক কাঠুরে একবার কাঠ কাটতে কাটতে হঠাৎ আনমনে বলে উঠলো - 'যমরাজ কি আমায় চোখে দেখে না'। তার কিছুক্ষণ পর যখন সে তার কাঠগুলো মাথায় করে নিয়ে বাড়ীর দিকে রওনা হচ্ছে হঠাৎ যমরাজ এসে হাজির। 'আমি তোমার প্রাণ নিতে এসেছি' - যমরাজ বলল। কাঠুরে ভয় পেয়ে গেলেও বুদ্ধির সাথে প্রশ্ন করল - 'কেন'। যমরাজ অবাক! 'তুমিই তো কিছুক্ষণ আগে বললে যে আমি তোমায় চোখে দেখি না'। কাঠুরে জবাব দিলো - 'হ্যাঁ বলেছিলাম, কিন্তু তা তো আমার প্রাণ নেওয়ার জন্য নয়, ভারি কাঠগুলো বাড়ী পর্যন্ত দিয়ে আসার জন্য'।  

কে মরতে চায় এই অস্বর্গ-অনরক পৃথিবীতে, তাইতো রসের খোঁজ।

সোমবার, ১৮ জুলাই, ২০১৬

মিশ্রণ - ৩

১) নাসিকার অন্দরমহলে পানির প্রবাহ মোটেও সুখকর বিষয় নয়। কিন্তু কি আর করা? ভদ্র সমাজে চলতে গেলে তো আর নাকে টিস্যু গুজে রাখা যায় না তাই একের পর এক টিস্যু ঘষে ফেলছি আর টিস্যু কোম্পানির ব্যাবসার উন্নতি করছি।
শরীরটা ভালো নেই দু'দিন ধরে। কতগুলো রোগ যে একসাথে ধরেছে কি বলব। ফর্মালিন খেয়ে খেয়ে বোধয় রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা জ্যামিতিক হারে কমতে শুরু করেছে। অফিস থেকে যে ছুটি নিয়ে কদিন রেস্ট নেবো তার তো জো নেই, তাই বাড়িতে মাকেই জ্বালাচ্ছি - এটা খাবো না ওটা খাবো, এরকম ভাবে না ওরকম ভাবে রাঁধো; আহা, রান্না সম্পর্কে যে আমার কত জ্ঞান! মা - বাবা আছে বলেই হয়তো এখনও আছি নইলে কবেই শেয়েল কুকুরে টেনে নিয়ে যেত।  

২) ভাষাহীনতা বলতে বোধয় কিছু হয় না, সবকিছুরি নিজস্ব একটা ভাষা আছে। যেমন ধরুন কিটারোর যন্ত্রসঙ্গীত। কি বলবেন এই যন্ত্রের ভাষাকে? আমার মতে 'মনের ভাষা' বলা উচিত, যাকে কোন অক্ষরে বাঁধা যায় না; শুধুই অনুভূতি।

কিটারো সম্পর্কে ইমন জুবায়ের ভাই তার ব্লগে চমৎকার একটা পোস্ট করেছিলেন, পড়ে দেখতে পারেন

৩) সারারাত ঘুম হয়নি, এপাশ-ওপাশ করছিলাম বিছানায়। শেষমেশ না পেরে উঠে পরলাম। ঘড়িতে তখন ছ'টা। শরীরটাও ভালো নেই যে বাইরে থেকে ঘুরে আসবো। ঠিক করলাম সিনেমা দেখবো। এতে যদি মনোযোগটা একটু খারাপলাগা থেকে সরে।
বসে গেলাম দেখতে - The Book Thief. কিছুক্ষণ দেখার পর শরীর খারাপের বিষয়টা আর অনুভবি করছিলাম না!
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মানির এক পরিবার লিসেল নামের এক মেয়েকে দত্তক নেয়। অন্য বাচ্চাদের থেকে ওঁ একটু আলাদা। ওঁ পড়তে ভালোবাসে। একদিন এক ইহুদী যুবক আসে তাদের বাড়িতে আশ্রয় নিতে। যুবকটি থাকতে শুরু করে তাদের বেজমেন্টে। এই যুবক অসুস্থ হলে লিসেল তাকে বই পড়ে শোনায়। বই সে কোথায় পায়? নাৎসিরা তো অনেক বই পুড়িয়েদিয়েছে। সে বই চুরি করে এক ধনাঢ্য পরিবারের লাইব্রেরী থেকে। যখনই কাছাকাছি কোথাও যুদ্ধ শুরু হয় তখন মহল্লার অনেকে মিলে লুকিয়ে পরে এক বিল্ডিঙের নিচে। সেখনে সে সবাইকে গল্প শোনায়, ভালোবাসার গল্প।
একসময় যুদ্ধ থেমে গেল। এরমধ্যেই সে হারিয়েছে অনেককিছু, অনেক প্রিয়জন। কিন্তু থেমে থাকেনা কিশোরী লিসেলের জীবন। জীবন শুধুই দুঃখময় নয়, সুখ, ভালোবাসা আর আশাও আছে। তার কোন এক আশার পূর্ণতা দিতেই হয়তো একদিন হঠাৎ সামনে এসে হাজির হয় বেজমেন্টে লুকিয়ে থাকা সেই পুরনো বন্ধুটির সঙ্গে।

বুধবার, ৬ জুলাই, ২০১৬

মিশ্রণ - ২

১) গত ঈদের আগের ঈদে, সকাল সকাল দরজায় ঠক-ঠক, কার না মেজাজ খারাপ হবে। কি আর করা, উথে গিয়ে দরজা খুললাম, দেখি পাঁচ-ছয় বছরের একটা ছেলে দরজায় দাড়িয়ে। মেজাজটা তখন আর খারাপ হয়ে নেই। ছেলেটা ভাত চাইলো। বুকের ভেতর একটা মোচড় দিয়ে উঠেছিলো। জিজ্ঞেস করে জানা গেল - ষ্টেশনে থাকে, বাবা নেই, সাথে থাকে মা আর ছোট বোন।
এরকম মানুষের সংখ্যা দেশে কম নয় যাদের ঈদের দিনেও ভাতের ক্ষুধা থাকে। নিজের জীবনের কষ্ট তো আছেই সেই সাথে এসকল মানুষের কষ্ট, কিছুতেই কোনটার কিনারা করা যাচ্ছে না; এটাই কি জীবন?
জাভেদ আক্তারের 'তো জিন্দা হো তুম' কবিতাটার কথা মনে পড়লো...

জীবন কি? সেই প্রশ্নের উত্তর দেওয়া আমার জন্যে কঠিন, আমি শুধু জানি আমি বেঁচে আছি আর তাই আমার জায়গা থেকে আমি কিছু করতে চাই, মানুষের জন্যে।

২) আসার কথা ছিল, এসে গেল; ঈদ। একটা কথা অনেককেই বলতে শুনি, ঈদে আর আগের মত আনন্দ পাই না; আমারও একই মত। কিন্তু কেন? হয়তো আমরা যখন ছোট ছিলাম তখন আমাদের দুঃখবোধ অতোটা গভীর ছিল না, তাই আনন্দটা দারুণ উপভোগ করতাম; পরিবেশও একটা কারন হতে পারে, এখন পরিবেশ আর আগের মত আনন্দদায়ক না।কারন যাই হোক, দিন বদলের জন্য আমাদের অবশ্যই নিজেদের বদলাতে হবে।

৩) এই লেখাটা লেখার মাঝখানে দুবার লোডশেডিং হল, বিদ্যুৎ নিয়ে তেমন একটা চিন্তা অবশ্য এখন না করলেও চলে কারন সুন্দরবন উজাড় করে রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র হলে সব ঠিক হয়ে যাবে, নাকি বলেন?

৪) গত দুদিন থেকে থেকেই ঝিরিঝিরি বৃষ্টি হয়েছে, আজ নেই তবে মুখ ভোতা করে আছে আকাশ। এরকম দিনে গরমের বিরক্তি থেকে রেহাই পাওয়া যায় ঠিকই কিন্তু আকাশ দেখে সুখ পাওয়া যায় না।ছোটবেলায় একবার দেখেছিলাম, ঈদের সারাটা দিন বৃষ্টি হয়েছিল। কে মানে বৃষ্টির বাঁধা, ছাতা নিয়ে সব দল বেধে বেরিয়ে পরে ছিলাম। দু-একজনের কাঁদায় পরে যাওয়াটাও তো স্বাভাবিক ছিল, পরলও। তারপর আর কি, ভ্যা ভ্যা কান্না আর বড়দের হাসাহাসি। না হেসে উপায় কি, কাঁদায় পরার পর চেহারাটা হয় দেখবার মত!
এই ঈদেও যদি সারাদিন বৃষ্টি হয়, তবে?

৫) ঈদ বিশেষ করে রমজানের ঈদ নিয়ে অনেক ভালো ভালো গান হয়েছে কিন্তু নজরুলের সেই গানের মত আর হয় না...



মঙ্গলবার, ৫ জুলাই, ২০১৬

মিশ্রণ - ১

১) খারাপ খবরটাই আজকাল খবরে পরিনত হয়েছে। যাদের কাছ থেকে আশ্বাস পাচ্ছি তাদের বেশিরভাগের উপরেই আমাদের বিশ্বাস নেই। দেশে নির্ভরযোগ্য মিডিয়া নেই বললেই চলে, নির্ভরতার জন্য আমাদের ঘাটতে হচ্ছে বাইরের মিডিয়াগুলো। নিয়মিত আতঙ্কিত এই পৃথিবীতে তবুও আমরা আশায় বুক বাঁধি। তাই নিচিকেতার সাথে সুর মেলাতে চাই...

যাইহোক আমাদের জীবন থেমে থাকবে না কোনোমতেই। শোক সুখ নিয়েই জীবন, জীবনকে বয়ে নিয়ে চলাই জীবন।

২) আমার এক মামা আছেন যিনি বেশ সাহসি আর রাগি। সাবাই তাকে বেশ সমঝে চলে। সবকিছুতেই তার একটা ডেমকেয়ার অবস্থান আছে শুধু বজ্রপাত ছাড়া, বজ্রপাত হলেই তিনি কেমন বদলে যান। দিশেহারা হয়ে যান, দৌড়ে ঘরের মধ্যে চলে এসে গুটিসুটি মেরে বসে থাকেন। আমার অবস্থা তার থেকে কিছুতা ভালো। আমি দিশেহারা হই না তবে ভয় লাগে খুব। তাই অনেকদিন ধরেই ভাবছিলাম এই বিষয়ে কিছু পড়াশোনা করবো, আজ সুযোগ পেয়ে করে ফেললাম।

বজ্রপাত কি এবং এর কারন জানতে এই লেখাটি পড়ুন অথবা এটি অথবা এটি আর বজ্রপাত থেকে বাঁচার উপায় জানতে এই লেখাটি পড়ুন। আপনার কি কোন ধারনা আছে এই মুহূর্তে পৃথিবীর কোথায় কোথায় বজ্রপাত হচ্ছে, আমার ধারনা আপনার জানা নেই; জানতে হলে এই ওয়েবসাইটটি দেখুন
খুঁজতে খুঁজতে আরও একটা জিনিস পেয়ে গেলাম, কি করে Cloud Light বানাবেন...

৩) আমি অনেকটা নিজের অজান্তেই বাংলা অনুবাদের দুনিয়ায় প্রবেশ করেফেলি, সেবা প্রকাশনীর পাঠক হিসেবে। অনুবাদের এই দুনিয়ার সাথে আমার পরিচয় না হলে আমার জীবনটা হতো আরও খানিকটা বৈচিত্র্যহীন, কল্পনাগুলো হতো আরও অনেক রংহীন। এতো বললাম বাংলা অনুবাদের কথা, এবার ওয়ার্ল্ড ওয়াইড অনুবাদের কথায় আসি। আচ্ছা আপনার কি কোন ধারনা আছে যে আজ অব্দি পৃথিবীতে কাদের লেখা বেশি অনুবাদ করা হয়েছে।না জানা থাকলে জেনে নিন এখান থেকে

অনুবাদের বিষয়টা না থাকলে পৃথিবী সম্পর্কে জানার জায়গাটা আরও অনেক সীমিত হয়ে যেত আমার মত আরও অনেকের। তাই অনুবাদের মাধ্যমে জানার পৃথিবীটাকে প্রসারিত করে দেওয়ায় পৃথিবীর সকল অনুবাদককে শ্রদ্ধা জানাই। 

৪) ভেজ-ননভেজের (আমিষ-নিরামিষ) কথা উঠলেই অনেকে ভারতকে একটা উদাহরণ হিসেবে টেনে নিয়ে আসেন। এবং এতা বুঝানোর চেষ্টা করেন যে ভারতের বেশিরভাগ মানুষই ভেজিটেরিয়ান যদিও বাস্তবতা ভিন্ন। সম্প্রতি The Huffington Post এবিষয়ে একটা আর্টিকেল প্রকাশ করেছে। নিচের ছবিটি উক্ত আর্টিকেল থেকেই নেওয়া হয়েছে... 

৫) একটা বিশ্ববিদ্যালয়ের খুব কাছেই আমার বাসা। যারফলে প্রচুর মেস আমার বাসার আশেপাশে। সবসময় মানুষ গমগম করে এলাকায়, অথচ ঈদের ছুটিতে? একেবারে উল্টো, খারাপই লাগে খাঁ খাঁ করা পরিবেশে। গতকাল তাই এই নিয়ে দুকলম কাব্যি করে ফেললাম -
আছি 
বহু মেসবাড়ির কাছাকাছি 
থরে থরে ঘর তাতে 
থরে থরে বাতি 
বিদ্যুৎ আছে তবুও 
লোডশেডিঙেই আছি!

শুক্রবার, ১০ জুন, ২০১৬

সংখ্যালঘু প্রসঙ্গে ~ বদরুদ্দীন উমর

বাংলাদেশে প্রকৃত সংখ্যালঘু কারা?
বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক পরিস্থিতি সৃষ্টি হওয়া ভারতের ক্ষমতাসীন দল বিজেপি ও তাদের পিতৃসংগঠন রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের (আরএসএস) জন্য খুব বেশি দরকার। চরমপন্থী সাম্প্রদায়িক দল হিসেবে ভারতে নিজেদের অবস্থান শক্তিশালী রাখার জন্যই এটা তাদের দরকার। কাজেই বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িকতা বলতে যা বোঝায় সেটা না থাকলেও সেই পরিস্থিতি তৈরির জন্য বিজেপি বেশ পরিকল্পিতভাবেই চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। একটি সংবাদপত্র রিপোর্ট থেকে দেখা যাচ্ছে (প্রথম আলো, ০১.০৬.২০১৬), বাংলাদেশ সফরে আসা বিজেপির একটি প্রতিনিধি দলের নেতা বিজেপির ন্যাশনাল এক্সিকিউটিভ কমিটির সদস্য অরুণ হালদার বিবিসিকে এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘বাংলাদেশে বহু হিন্দু তাদের বলেছেন যে দেশটিতে তারা এখন নিরাপদ বোধ করছেন না। বাংলাদেশে হিন্দুদের মনোবলে চিড় ধরেছে, সেটি ফিরিয়ে আনতে হবে। বাংলাদেশী হিন্দুদের এই মনোভাব তারা ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির কাছেও তুলে ধরবেন।’ এছাড়া অরুণ হালদার আরও বলেন, ‘কিছুদিন আগে হিন্দুধর্মাবলম্বী একজন প্রধান শিক্ষককে কান ধরে ওঠবস করানো হয়। এছাড়া বিভিন্ন জায়গায় বিচ্ছিন্ন খবরাখবর আসে নির্যাতনের। সেগুলো শুনেও ভাবতাম যে বিচ্ছিন্ন কিছু ঘটছে। কিন্তু এখন হাজার হাজার মানুষ এ জিনিসটাই বলছে।’

বিজেপির প্রতিনিধি দলের এসব কথাবার্তা যে সম্পূর্ণ মিথ্যা এবং সাম্প্রদায়িক উসকানিমূলক এতে সন্দেহ নেই। কারণ বাংলাদেশে হিন্দু সম্প্রদায়ভুক্ত লোকদের ওপর এ ধরনের কোনো নির্যাতন বাস্তবত নেই। দেশে সাধারণভাবে যে নৈরাজ্য এবং আইনশৃংখলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটেছে, তাতে সম্প্রদায় নির্বিশেষে মানুষকে নির্যাতন করা হচ্ছে, তাদের নিরাপত্তা বিপন্ন হচ্ছে, অনেকে আওয়ামী লীগ ও তাদের সরকারি লোকদের দ্বারা অপহৃত ও নিহত হচ্ছেন। এদের মধ্যে মুসলমানদের সংখ্যাটি সব থেকে বেশি, কারণ দেশে ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মধ্যে তারাই বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ। কিন্তু হিন্দুরা বাংলাদেশের জনসংখ্যার একটি অংশ, শতকরা নয়-দশ ভাগের মতো। কাজেই সাধারণভাবে দেশে সরকারি ও বেসরকারি ক্রিমিনালদের দ্বারা মানুষের ওপর যে নির্যাতন হচ্ছে, তার দ্বারা জনগণের অংশ হিসেবে তারাও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। তবে এটাও বলা দরকার যে, হিন্দুদের জনসংখ্যার তুলনায় এ সংখ্যা অল্প। কিন্তু এক্ষেত্রে যা লক্ষ করার বিষয় তা হচ্ছে, মুসলমানরা অনেক অধিক সংখ্যায় ক্ষতিগ্রস্ত, এমনকি নিহত হলেও কেউ বলে না যে, মুসলমানরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বা সাম্প্রদায়িকভাবে মুসলমানদের ওপর আক্রমণ হচ্ছে। কিন্তু কোনো হিন্দু এভাবে নির্যাতনের শিকার হলেই কিছু লোক সমস্বরে বলতে থাকে, ‘হিন্দুদের’ ওপর নির্যাতন হচ্ছে! কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এই নির্যাতন হিন্দু বলে হচ্ছে না। যারা অন্যদের জমি দখল করছে, ঘরবাড়ি লুটপাট করছে, মানুষের ওপর নির্যাতন করছে- তারা চোর, ডাকাত, অপহরণকারী ক্রিমিনাল- কোনো সাম্প্রদায়িক দুষ্কৃতকারী নয়। তাদের এই আক্রমণের সঙ্গে সাম্প্রদায়িকতা বা বিশেষভাবে হিন্দুদের ওপর নির্যাতনের কোনো ব্যাপার নেই। কিন্তু বাংলাদেশে ভারতের গোয়েন্দা বিভাগের সঙ্গে সম্পর্কিত হাতেগোনা কিছু লোক এবং আওয়ামী লীগের একজন নেতৃস্থানীয় হিন্দু নেতার মতো চরম সাম্প্রদায়িক ব্যক্তিরাই এ ধরনের কথাবার্তা বলছেন। মাদারীপুরে একটি ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক অনুষ্ঠানে যোগ দিতে এসে সত্যিই যদি বিজেপি নেতা অরুণ হালদার হিন্দুদের উপরোক্ত বক্তব্য শুনে থাকেন তাহলে তারা হল সেই আওয়ামী লীগ নেতার মতোই সাম্প্রদায়িক হিন্দু। এদেশের সাধারণ হিন্দু নয়। সেক্ষেত্রে ‘হাজার হাজার’ হিন্দুর থেকে এ ধরনের কথাবার্তা শোনার কোনো সুযোগও তার ছিল না। এসব হল পরিকল্পিত ও মিথ্যা সাম্প্রদায়িক প্রচারণা, যে কাজ করাতে বিজেপি সিদ্ধহস্ত।

বিজেপি বাংলাদেশে অনেক আগে থেকেই নানাভাবে ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতায় উসকানি দেয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছে। কিছুদিন আগে পশ্চিমবঙ্গের এককালীন বিজেপি সভাপতি তথাগত রায় (বর্তমানে পদোন্নতি পেয়ে ত্রিপুরার রাজ্যপাল) বাংলাদেশে এসে ঢাকেশ্বরী মন্দিরসহ কয়েক জায়গায় সভা-সমিতি করেন। ঢাকেশ্বরী মন্দিরের এক সভায় আওয়ামী লীগের অন্যতম বড় নেতা সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বলেন, বিজেপি কোনো সাম্প্রদায়িক দল নয়! তারা কৌশলগত কারণেই সাম্প্রদায়িক কথাবার্তা বলে থাকে!! এর থেকে দুরভিসন্ধিমূলক সাম্প্রদায়িক বক্তব্য আর কী হতে পারে? একথা বলছেন এমন এক ব্যক্তি যিনি আওয়ামী লীগের পরম আশ্রিত, বহু সম্পত্তি ও ধনদৌলতের মালিক এবং রেলওয়ের তহবিল চুরি কেলেংকারির প্রধান নায়ক!! প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশের সাধারণ হিন্দুরা নয়, এ ধরনের দুর্নীতিবাজ হিন্দু সম্প্রদায়ভুক্ত লোকই বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িকতা সম্পর্কে নানা ধরনের অপপ্রচার চালিয়ে যাচ্ছে।

বিজেপি নেতা অরুণ হালদার একজন ‘হিন্দু’ হেডমাস্টারকে কান ধরে ওঠবস করার বিষয় উল্লেখ করেছেন। কিন্তু ‘হিন্দু’ হিসেবে তাকে দিয়ে এ কাজ করানো হয়নি। এ ধরনের কাজ অনেক মুসলমানকে দিয়েও দুর্বৃত্তরা করছে। এর সঙ্গে সাম্প্রদায়িকতার কোনো সম্পর্ক নেই। কিন্তু একে সাম্প্রদায়িক আখ্যা দিয়ে মিথ্যাচার করলেও এর চেয়ে বড় যে অন্যায় তিনি করেছেন সেটা হল, এই ‘হিন্দু’ হেডমাস্টারের অবমাননার পর দেশজুড়ে স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক-বুদ্ধিজীবী ও সাধারণ মানুষের ব্যাপক বিক্ষোভ, জনসভা, মিছিল ইত্যাদির কথা সম্পূর্ণ চেপে গিয়েছেন!!! এই বিক্ষোভকারীদের মধ্যে শতকরা ৯৫ ভাগই হচ্ছে মুসলমান!

প্রথমেই বলেছি, বাংলাদেশে ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতা জোরদার হচ্ছে- এটা প্রচার করা ভারতের ক্ষমতাসীন চরম সাম্প্রদায়িক দল বিজেপির জন্য প্রয়োজন নিজেদের সাম্প্রদায়িকতাকে ভারতের জনগণের কাছে যুক্তিযুক্ত করার উদ্দেশ্যে। এজন্য তারা সর্বপ্রকারে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। আসলে তাদের নতুন সরকার ও তাদের মুখ্যমন্ত্রী বাংলাদেশের বিরুদ্ধে বিষোদগার করে বলেছেন, বাংলাদেশের সঙ্গে তাদের রাজ্যের সীমানা তারা দেয়াল বা কাঁটাতার দিয়ে একেবারে বন্ধ করে দেবেন। এটা যে কোনো বন্ধুসুলভ ও অসাম্প্রদায়িক কাজ নয় তা বলাই বাহুল্য। শুধু এটাই নয়, বাংলাদেশের সঙ্গে ভারত সরকার যে আচরণ সর্বক্ষেত্রে করে যাচ্ছে এবং বাংলাদেশ তা মেনে নিচ্ছে, তাতে এটা মনে হওয়া স্বাভাবিক যে, বাংলাদেশ হল ভারতের বন্ধুরাষ্ট্র, যা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে।

এবার আসা যেতে পারে সংখ্যালঘু বিষয়ক অন্য প্রসঙ্গে। বাংলাদেশে শুধু ধর্মীয় সংখ্যালঘুই নেই। আছে জাতিগত ও ভাষাগত সংখ্যালঘু। কিন্তু সংখ্যালঘু বলতে এখন শুধু হিন্দুদেরই বোঝানো হয়ে থাকে। সংখ্যালঘু সমস্যা বলতে শুধু বোঝায় হিন্দুধর্ম সম্প্রদায়ভুক্ত লোকদের সমস্যা। এক্ষেত্রে মনে রাখা দরকার, বাংলাদেশে প্রথম থেকেই এক ধরনের উগ্র জাতীয়তাবাদীদের প্রাধান্য। এই উগ্র জাতীয়তাবাদ হচ্ছে বাঙালি জাতীয়তাবাদ। এই জাতীয়তাবাদী অবস্থান থেকেই শেখ মুজিব ১৯৭২ সালে চাকমা নেতা সংসদ সদস্য মানবেন্দ্র লারমাকে বলেছিলেন, জাতীয় সংখ্যালঘু বলে বাংলাদেশে কিছু নেই। কাজেই তাদের বিশেষ অধিকারের কোনো প্রশ্ন নেই! শুধু তাই নয়, তিনি তাদের বলেছিলেন বাঙালি হয়ে যেতে!! শেখ মুজিব চাকমা ইত্যাদি জাতিগত সংখ্যালঘুদের যেভাবে বাঙালি হয়ে যেতে বলেছিলেন তার অর্থ বাংলাদেশে বাঙালিরই একক রাজত্ব। এবং হিন্দুরা এই বাংলাদেশীদেরই অংশ। হিন্দুরা ধর্মীয়ভাবে সংখ্যালঘু হলেও জাতিগতভাবে সংখ্যাগুরু। কাজেই যে বাঙালিরা বাংলাদেশে শাসন ক্ষমতায় রয়েছে তাদের মধ্যে বাঙালি হিন্দুরাও আছে। এটা মনে রাখা দরকার, বাংলাদেশে মুসলমানদের শাসন বলে যদি কিছু থাকে তার থেকেও গুরুত্বপূর্ণ হল বাঙালিদের শাসন। এদিক দিয়ে আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টির মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। তারা সবাই পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন সংখ্যালঘু জাতি এবং সাঁওতাল, গারো, হাজং, রাখাইন ইত্যাদি জাতিগত সংখ্যালঘুদের স্বার্থবিরোধী। এরা সবাই নিজেদের সুযোগ-সুবিধা এবং ব্যবস্থা অনুযায়ী এসব জাতিগত সংখ্যালঘু এবং উর্দুভাষী অবাঙালি সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতনকারী। আজ পর্যন্ত তারা এদের কারও প্রতি বন্ধুসুলভ আচরণ করেনি। তাদের সুযোগ-সুবিধার দিকে তাকায়নি। উপরন্তু সংখ্যালঘু হিসেবে তাদের ওপর বাংলাদেশের সর্বত্র যে শোষণ-নির্যাতন চলে সে শোষণ-নির্যাতন ধর্ম নির্বিশেষে হিন্দু-মুসলমান বাঙালিরা একত্রেই করে থাকে। এদিক দিয়ে সংখ্যালঘুদের মধ্যে হিন্দুদের বিশেষ অবস্থান আছে। শ্রেণীবিভক্ত সমাজে যে কোনো সংখ্যালঘুর যেমন কিছু অসুবিধা থাকে, বাংলাদেশের হিন্দুদেরও তা আছে, যদিও তার গুরুত্ব বিশেষ নেই। কারণ তারা একদিকে সংখ্যালঘু আবার অন্যদিকে জাতিগত সংখ্যাগুরু হিসেবে বাঙালি শাসকশ্রেণীর অংশ। যারা বাংলাদেশে হিন্দুদের ওপর সাম্প্রদায়িক নির্যাতন নিয়ে উচ্চকণ্ঠ প্রচার করেন তাদের এসব বিষয়ে খেয়াল করা দরকার হলেও সে খেয়াল তারা করেন না। কারণ তাদের খুঁটি যেখানে বাঁধা আছে সেখানে এ বিষয়ে ঔদাসীন্য ও নীরবতাই তাদের স্বার্থের পক্ষে অনুকূল।

বাংলাদেশে সাঁওতাল, গারো, হাজং, রাখাইন, উর্দুভাষী চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা ইত্যাদি জাতিগত সংখ্যালঘুর ওপর যে অবর্ণনীয় নির্যাতন হয়, তার কথা সংবাদপত্রে বা টেলিভিশনে বিশেষ পাওয়া যায় না। অথচ নীরবে তাদের ওপর নির্যাতনের শেষ থাকে না। জমি-ঘরবাড়ি থেকে উচ্ছেদ, হত্যাকাণ্ড পর্যন্ত নিয়মিত হচ্ছে। কিন্তু তার বিরুদ্ধে বিশেষ কোনো উচ্চবাচ্য নেই। এর অন্যতম প্রধান কারণ তারা অবাঙালি এবং তুলনায় অনেক গরিব। এছাড়া হিন্দুদের বিরুদ্ধে সামান্য কিছু হলেও যেমন তা নিয়ে ভারতের মতো পার্শ্ববর্তী শক্তিশালী রাষ্ট্রে উত্তাপ সৃষ্টি ও প্রচারণা হয়, সেখান থেকে বাংলাদেশ সরকারকে হুমকি দেয়া হয়, সে রকম কিছু জাতিগত ও ভাষাগত সংখ্যালঘুদের ক্ষেত্রে হয় না। করণ তাদের পক্ষে দাঁড়ানোর মতো কোনো বাইরের রাষ্ট্র নেই। কিছুদিন আগে মিরপুরে বিহারিদের একটি শরণার্থী শিবিরে স্থানীয় এমপি ও পুলিশের উপস্থিতিতে বস্তি উচ্ছেদ অভিযানের সময় দশজনকে একঘরে বদ্ধ রেখে পুড়িয়ে মারা হলেও তার কোনো মামলা নিতে স্থানীয় পল্লবী থানা রাজি হয়নি। তার কোনো প্রতিকারও আজ পর্যন্ত হয়নি। কোনো হিন্দুবাড়ি এভাবে আক্রান্ত হলে এবং দশজনকে জীবন্ত পুড়িয়ে মারলে ভারতজুড়ে তার কী প্রতিক্রিয়া হতো এটা বলাই বাহুল্য।

বাংলাদেশে হিন্দু জনসংখ্যা শতকরা ৯/১০-এর কাছাকাছি। কিন্তু তাদের চাকরি শতকরা ৯/১০ ভাগের থেকে কম নয়। কিছু বেশিই হবে। শুধু তাই নয়, বাংলাদেশের এই হিন্দুরা সরকারি ও বেসরকারি অনেক উচ্চপদে অধিষ্ঠিত। গান, নাচ, নাটক, সিনেমা, সাহিত্য, প্রচারমাধ্যম, রাজনীতি ইত্যাদি সর্বক্ষেত্রে হিন্দুদের অবস্থান উল্লেখযোগ্য। সমাজে সব ক্ষেত্রে তাদের অবস্থা সম্মানজনক। অন্য জাতিগত ও ভাষাগত সংখ্যালঘুদের ক্ষেত্রে এটা দেখা যায় না বললেই হয়। অথচ বাংলাদেশে সংখ্যালঘু বলতে বোঝায় শুধু হিন্দুদের এবং সংখ্যালঘুর বিরুদ্ধে নির্যাতন বলতে বোঝায় হিন্দুদের ওপর নির্যাতন! এর থেকে সত্যের বড় অপলাপ আর কী হতে পারে? এই অসত্য ও মিথ্যার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে আজ স্পষ্টভাবে প্রকৃত সংখ্যালঘু সমস্যাকে সামনে আনা দরকার, যে সংখ্যালঘু ধর্মীয় সংখ্যালঘু হিন্দুরা নয়। তারা হলেন জাতিগত ও ভাষাগত সংখ্যালঘু, বিশেষত সারা দেশে ছড়িয়ে থাকা জাতিগত সংখ্যালঘু সাঁওতাল, গারো, রাখাইন, হাজং এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের ১৩টি জাতিসহ বাংলাদেশের প্রায় ৪৫টি সংখ্যালঘু অবাঙালি জাতি।


সূত্র - দৈনিক যুগান্তর (০৫ জুন, ২০১৬)

সংখ্যালঘু ও সাম্প্রদায়িকতা বিতর্ক প্রসঙ্গে
৫ জুন যুগান্তরে আমার প্রবন্ধ ‘বাংলাদেশে প্রকৃত সংখ্যালঘু কারা?’ প্রকাশিত হওয়ার পর তার বক্তব্য নিয়ে ‘ফেসবুকে’ বহু মন্তব্য ও প্রবন্ধ পর্যন্ত প্রকাশিত হয়েছে। আমি নিজে ‘ফেসবুক’ ব্যবহার করি না। কয়েকজন বন্ধু কতকগুলো লেখার প্রিন্ট কপি আমাকে দেয়ায় আমি তার মধ্যে বাছাই করে কয়েকটি পড়েছি। এত অধিক সংখ্যায় এভাবে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত হতে দেখে আমি একটু বিস্মিত হয়েছি। এসব প্রতিক্রিয়ার মধ্যে অনেকগুলো আমার বক্তব্যের বিরূপ সমালোচনা, যার মধ্যে গালাগালিও অন্তর্ভুক্ত। বাংলাদেশে মননশীলতা ও সিরিয়াস চিন্তার অভাব খুব প্রকট। যে ধরনের রাজনৈতিক বিতর্ক ব্রিটিশ, এমনকি পাকিস্তানি আমলেও দেখা যেত তার কোনো ঐতিহ্যিক ধারাবাহিকতা বাংলাদেশে আর থাকেনি বললেই চলে। রাজনীতি ক্ষেত্রে তাই প্রকৃত বিতর্কের স্থান দখল করেছে গালাগালি। অবস্থা এমন যে, গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে কোনো বিতর্কের অবতারণা কেউ করলেও তার জবাবে বিতর্কের পরিবর্তে পাওয়া যায় গালাগালি, এমনকি ব্যক্তিগত কুৎসা। শুধু তাই নয়, দর্শন, সাহিত্য সমালোচনা বলেও কোনো কিছু বাংলাদেশের সাহিত্যচর্চার মধ্যে নেই। চিন্তা ও মননশীলতার এ হতদরিদ্র অবস্থায় বাংলাদেশকে মনে হয় একটা ডোবার মতো স্থির ও নিস্তরঙ্গ। এ নিস্তরঙ্গ ডোবায় তরঙ্গ সৃষ্টির একটা পথ হল, চিন্তা ক্ষেত্রে যথার্থ বিতর্ক এবং মননশীলতার গুরুতর চর্চা। এ পরিস্থিতিতে গুরুতর ও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে বিতর্ক ভালো। আমার প্রবন্ধটি নিয়ে যে বিতর্ক চলছে তার বিষয়বস্তু গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু এতে অংশগ্রহণকারী অধিকাংশ ব্যক্তিই বিতর্কের ব্যাকরণ বিষয়ে নিরীহ। কাজেই তাদের ক্ষেত্রে বিতর্কের নামে এমন বেশ কিছু কথা বলা হয়েছে যাতে তথ্যের উপস্থিতি ও যুক্তির জোর নেই। এটা বিদ্বেষেরই পরিচায়ক। মূল বিষয়ে আলোচনার আগে এসব কথা কেন বলা প্রয়োজন হল, এটা ফেসবুকে প্রকাশিত লেখাগুলো যারা পড়েছেন তাদের পক্ষে বোঝার অসুবিধা হবে না। কিন্তু যারা সেগুলো পড়েননি, তাদেরও এ বিষয়ে কিছু ধারণা দেয়ার চেষ্টা এখানে করা হল।

সংখ্যালঘু প্রশ্ন নতুন নয়, যদিও ব্রিটিশ-পূর্ব ভারতে এ প্রশ্ন ছিল না। ভারতে শব্দটির প্রচলন করেছিল ইংরেজরা। তারা ভারতীয়দের শিখিয়েছিল সংখ্যালঘুর অর্থ হল, ধর্মীয় বিশ্বাসের দিক থেকে কোনো দেশে যাদের সংখ্যা কম। সংখ্যাগুরু তারা যাদের সংখ্যা বেশি। উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধ থেকে বিশ শতকে ভারত ত্যাগের আগ পর্যন্ত তাদের এ তালিম শিরোধার্য করেই ভারতে সংখ্যালঘু ও সংখ্যাগুরু বলতে সব সময়েই এ বিভাজনের ভিত্তি হিসেবে দাঁড় করানো হয়েছে ধর্মকে। রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহারও হয়েছে এভাবে। রাজনীতির সাম্প্রদায়িকীকরণও ঘটেছে এরই সূত্র ধরে। ইংরেজের দেয়া শিক্ষা যে ১৯৪৭ সালের এতদিন পরও ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশের শিক্ষিত লোকদের- বুদ্ধিজীবী, রাজনীতিবিদ, লেখক, সাহিত্যিক, সংস্কৃতিকর্মী ইত্যাদির- মস্তিষ্ক শাসন করছে তার প্রমাণ এখনও পর্যন্ত সংখ্যাগুরু ও সংখ্যালঘু বলতে তারা বোঝেন, বা প্রধানত বোঝেন, ধর্মীয় সংখ্যাগুরু ও সংখ্যালঘু। যারা নিজেদের ধর্মনিরপেক্ষ বা ধর্মবিযুক্ত (Secular) বলেন, তারাও চিন্তার এই বৃত্তের মধ্যেই ঘুরপাক খান! ইংরেজের ধর্ম শিক্ষার হাত থেকে তাদেরও নিস্তার নেই!!

এ পরিস্থিতিতে কোনো কোনো বুদ্ধিজীবী নমঃনম করে অন্য ধরনের সংখ্যাগুরু ও সংখ্যালঘুর একটা অস্তিত্ব স্বীকার করলেও তারা ধর্মীয় মানদণ্ডেই জনগণকে বিভক্ত করে অন্যদের বোঝাতে চান, এটাই সমাজের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র। কাজেই এ সমস্যার সমাধান হলেই সমাজে সমতা, ঐক্য, শান্তি সবকিছুই প্রতিষ্ঠিত হবে! এ চিন্তা করতে গিয়ে সমাজের সব থেকে মৌলিক দ্বন্দ্ব, শ্রেণী দ্বন্দ্বের বিশেষ কোনো গুরুত্ব তাদের কাছে নেই। এ বিষয়ে একটু পরেই আরও কিছু আলোচনার প্রয়োজন হবে।

‘ফেসবুকে’ যারা এ বিষয়ে আলোচনা করেছেন, তাদের প্রত্যেকের বক্তব্য পৃথকভাবে আলোচনা করা এখানে সম্ভব নয়। তার অন্যতম কারণ এসব লেখালেখির সংখ্যা। কাজেই আমি তাদের বিতর্কের মধ্যে যেসব বিষয় গুরুত্বপূর্ণ মনে করেছি সেগুলো নিয়েই কিছু সংক্ষিপ্ত আলোচনা এখানে করব। এ ক্ষেত্রে অবশ্য বলা দরকার, বেশ কয়েকটি লেখা বা কিছু মন্তব্য একেবারেই আবর্জনাতুল্য। আমার প্রবন্ধটির ওপর যোগ্যতার সঙ্গে আলোচনার পরিবর্তে এসব লেখার মালিকরা আমার সারা জীবনের যা কিছু কাজ সব শিকেয় তুলে আমার বিরুদ্ধে অপবাদ দিয়েছে যে, আমি ‘দগদগে হিন্দু-বিদ্বেষে পূর্ণ’, ‘মুসলিম জাত্যাভিমানের কারণে আমি মাংসকে গোস্ত বলি’, আমি ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের অর্থাৎ হিন্দুদের খারিজ করেছি, আমি বলেছি বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ অস্থিতিশীলতা ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির মূল নিয়ামক, আমি বলেছি বাংলাদেশে হিন্দুদের ওপর কোনো আক্রমণ হয়নি, হিন্দুরা বাংলাদেশে মহাসুখে আছে ইত্যাদি ইত্যাদি। এ ধরনের মিথ্যা ও উদ্ভট আবোলতাবোল কথার শেষ নেই। এসব যারা লিখেছেন তাদের মন্তব্য ও বক্তব্য আলোচনার সম্পূর্ণ অযোগ্য।

কোনো কোনো বক্তব্য আছে যা অজ্ঞতার ফল। যেমন একজন বলছেন, আমার যুক্তি ‘সাম্প্রদায়িকতাকে শুধুমাত্র অর্থনৈতিক বিচার থেকে দেখার দোষে দুষ্ট’। আমার অবস্থান সম্পর্কে এর থেকে বিভ্রান্তিকর ও অজ্ঞ বক্তব্য আর কী হতে পারে? আমিই এ দেশে প্রথম সাম্প্রদায়িকতার যথার্থ সংজ্ঞা নির্দেশ করে তার হাজারো দিক সম্পর্কে আলোচনা করে তার বিরুদ্ধে পাকিস্তান আমলে ষাটের দশক থেকে সংগ্রাম করে আসছি। পাকিস্তান আমলে সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে আমার প্রথম তিনটি বইয়ের নাম ছিল ‘সাম্প্রদায়িকতা’, ‘সংস্কৃতির সংকট’ ও ‘সাংস্কৃতিক সাম্প্রদায়িকতা’। সে বইগুলোতে সাম্প্রদায়িকতাকে কি শুধু অর্থনৈতিক বিচারে দেখা হয়েছে? এ দেশের সাম্প্রদায়িকবিরোধী আন্দোলন বিষয়ে একজন কতখানি অজ্ঞ থাকলে একথা বলা সম্ভব এটা সহজেই অনুমেয়। শুধু তাই নয়, আমি সাম্প্রদায়িকতা ও ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহার সম্পর্কে যে বিশ্লেষণ উপস্থিত করেছিলাম এবং তার ভিত্তিতে শুধু সাম্প্রদায়িকতাই নয়, পরবর্তীকালে ধর্মের সব ধরনের রাজনৈতিক ব্যবহারের বিরুদ্ধেই যেভাবে সংগ্রাম করেছি তার পরিচয় আমার অজস্র প্রবন্ধের মধ্যে আছে যেগুলো গ্রন্থবদ্ধও হয়েছে। কাজেই আমি সাম্প্রদায়িকতাকে শুধু অর্থনৈতিক বিচারেই দেখি এটা অজ্ঞতাপ্রসূত ফল যদি না হয়, তাহলে অবশ্যই দুরভিসন্ধিমূলক।

এটা আমি অবশ্যই বলেছি যে, সাম্প্রদায়িকতার মূল ভিত্তি অর্থনৈতিক এবং সে ভিত্তি অপসারিত হলে সাম্প্রদায়িকতা দুর্বল হয়ে পড়ে এবং শেষ পর্যন্ত রাজনৈতিকভাবে অকার্যকর হয়। যেমনটি ঘটেছিল পাকিস্তান আমলে পূর্ববাংলায়। কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে, সাম্প্রদায়িকতার অন্য কোনো দিক নেই। শুধু তাই নয়, এ অন্য দিকগুলোর আলোচনাই আমার উপরোক্ত তিনটি বইয়ের প্রবন্ধগুলোর মধ্যে আছে। বাইরের পরিচয় যাই হোক, প্রকৃতপক্ষে মার্কসবাদবিরোধী লোকদের এক পরিচিত অভ্যাস হল এটা বলা যে, মার্কসবাদীরা অর্থনৈতিক ভিত্তি ছাড়া অন্য কোনো কিছুকে গ্রাহ্য মনে করে না। খোদ মার্কসের বিরুদ্ধে বুর্জোয়া সমালোচকদের এ ধরনের কথাবার্তার অভাব নেই, যাকে মিথ্যা ও কুৎসা ছাড়া অন্য কিছু বলা যায় না।

এ দেশে বামপন্থীদের মধ্যে কেউ কেউ মনে করেন, গ্রামাঞ্চলে এখনও জনগণের সঙ্গে প্রধান দ্বন্দ্ব সামন্তবাদের। এ বক্তব্যের যে কোনো বাস্তব ভিত্তি নেই এটা বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলের বর্তমান আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতির সঙ্গে যাদের যথার্থ পরিচয় আছে এবং এ পরিস্থিতি ঠিকমতো বিশ্লেষণ করতে সক্ষম, তারা জানেন। কিন্তু গ্রামাঞ্চলে অর্থনীতি ক্ষেত্রে সামন্তবাদের অতি সামান্য কিছু অবশেষ থাকলেও সমাজের উপরিকাঠামোতে সামন্তবাদের প্রভাব এখনও যথেষ্ট শক্তিশালী। শুধু গ্রামাঞ্চলে নয়, শহরের মধ্যবিত্ত-উচ্চবিত্তদের একটা বিরাট অংশের চিন্তা-চেতনাতেও সামন্তবাদের শক্তিশালী উপস্থিতি আছে। এ উপস্থিতির মূলে তাদের মধ্যে এক ধরনের ধার্মিকতারও অভাব নেই। সাম্প্রদায়িকতার ক্ষেত্রেও একই ব্যাপার। অর্থনীতিতে হিন্দু-মুসলমান সাম্প্রদায়িকতার ভিত্তি না থাকলেও সমাজের উপরিকাঠামোতে তার অস্তিত্ব অবশ্যই আছে, যা আমি আমার অনেক লেখাতেই বলেছি। ভিত্তিভূমিতে বিপ্লবী পরিবর্তন হলেও উপরিকাঠামোতে পরিবর্তন ঘটে ধীরে ধীরে, সময় নিয়ে।

সাম্প্রদায়িকতা হল ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহারের একটি রূপ। উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধ থেকে ১৯৪৭ সালে স্বাধীনতা পর্যন্ত সাম্প্রদায়িকতাকেই ধর্মের সব থেকে পরিচিত ও শক্তিশালী রূপ হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। পরবর্তীকালে ব্রিটিশ সরকার ভারতের গভর্নর জেনারেল লর্ড মাউন্ট ব্যাটেনকে দিয়ে যেভাবে ভারত বিভক্ত করেছিল, তাতে সাম্প্রদায়িকতা ভারত ও পাকিস্তান রাষ্ট্রে দ্বন্দ্ব-সংঘর্ষের মাধ্যমে জিইয়ে রাখার চক্রান্ত ছিল। সে চক্রান্ত এখনও পর্যন্ত কার্যকর আছে। ভারত-পাকিস্তান দ্বন্দ্ব-সংঘর্ষ হল হিন্দু-মুসলমান দ্বন্দ্ব-সংঘর্ষেরই স্বাধীনতা-উত্তর রূপ। এদিক দিয়ে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতির মধ্যে প্রথম থেকেই পার্থক্য সৃষ্টি হয়। ব্রিটিশ আমলে পূর্ববাংলায় অধিকাংশ জমিদার, জোতদার, মহাজন, ব্যবসায়ী ইত্যাদি উচ্চ শ্রেণীর লোকরা ছিল ধর্মগতভাবে হিন্দু এবং মুসলমানরা ছিল বিপুল অধিকাংশই প্রজা, ভাগচাষী, খাতক ও দরিদ্র ক্রেতা। ১৯৪৭ সালের পর এ সম্পর্কের পরিবর্তন ঘটে। অর্থনীতি ক্ষেত্রে হিন্দুদের প্রাধান্য দ্রুত কমে এসে প্রতিষ্ঠিত হয় মুসলমান জোতদার, মহাজন, ব্যবসায়ীদের প্রাধান্য। এ কারণে ব্রিটিশ আমলে এ অঞ্চলে হিন্দু-মুসলমানের সম্প্রদায়গত দ্বন্দ্ব যেভাবে ছিল তার অবসান ঘটে। সাম্প্রদায়িকতার অর্থনৈতিক ভিত্তি অপসারিত হতে থাকার সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয় রাজনীতি, সংস্কৃতি ইত্যাদির অসাম্প্রদায়িকীকরণ। সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক দলের ভিত্তি বিনষ্ট হওয়ার ফলে মুসলিম লীগ পাকিস্তানে শাসক দল হলেও ১৯৫৪ সালের নির্বাচনের পর পূর্ববাংলায় রাজনৈতিক দল হিসেবে বিলুপ্ত হয়। তারপর এখানে উত্থান হয় অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির, যার ফলে ১৯৫৪ সালের নির্বাচনের পর আওয়ামী মুসলিম লীগের পক্ষে সাম্প্রদায়িক দল হিসেবে অগ্রসর হওয়ার কোনো সম্ভাবনা আর না থাকায় তারা নাম পরিবর্তন করে হয় ‘আওয়ামী লীগ’। আওয়ামী লীগের অসাম্প্রদায়িকীকরণ ছাড়াও পূর্ববাংলায় অন্যান্য গণতান্ত্রিক ও সমাজতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল এবং গণ ও শ্রেণী সংগঠন গড়ে ওঠে। এক কথায়, সাম্প্রদায়িকতার পর এখানে উত্থান ঘটে বাঙালি জাতীয়তাবাদের এবং সমাজতান্ত্রিক চিন্তাধারার জনপ্রিয়তাও বৃদ্ধি পায়। ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান এবং ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের পর জনগণ সাম্প্রদায়িকতা থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে মুক্ত হয়ে এখানে প্রতিষ্ঠিত হয় বাঙালিদের একটি স্বাধীন রাষ্ট্র। এ রাষ্ট্রে হিন্দু-মুসলমান উভয় ধর্মীয় সম্প্রদায়ের বাঙালিরই রাজনৈতিক বিজয় হয়েছিল। তারা এ রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছিল শাসক শ্রেণীতে। এ কথা কি বলা যায় যে, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে শুধু মুসলমান বাঙালিরাই ক্ষমতাসীন হয়েছিল, আর হিন্দুরা পাকিস্তান আমলের মতোই থেকে গিয়েছিল শাসক শ্রেণীর বাইরে সাম্প্রদায়িক সংখ্যালঘু হিসেবেই? সেটাই কি ছিল মুক্তিযুদ্ধের ‘মহান’ বিজয়? আমি হিন্দুদের বাঙালি শাসক শ্রেণীর অংশ বলায় যারা আমার ওপর গালিবর্ষণ করে নিজেদের ‘অসাম্প্রদায়িক’ প্রমাণের চেষ্টা করেছেন, তারা কি এভাবে হিন্দুদেরকে বাঙালি মুসলমান থেকে পৃথক করে বাঙালি হিন্দুকে হিন্দু হিসেবে শাসক শ্রেণীর বাইরে রেখে রাজনীতিতে সাম্প্রদায়িকতা জিইয়ে রাখা ও শক্তিশালী করার অপচেষ্টায় লিপ্ত নন?

কেউ কেউ বলেছেন, আমি হিন্দুদের শাসক শ্রেণীর অংশ বলেছি; কিন্তু হিন্দু গরিব ও শোষিত-নির্যাতিতরা কি শাসক শ্রেণীর অংশ? এ ধরনের বালখিল্য কথাবার্তা থেকে মনে হয়, বাংলাদেশে বিতর্কের মানের কোনোই উন্নতি হয়নি। যারা এভাবে প্রগতিশীলতার নামে বিতর্ক করেন, বিতর্কের ব্যাপারে তাদের দক্ষতার নামগন্ধ নেই। কারণ এ ক্ষেত্রে যা লক্ষ করার বিষয় তা হল ‘শ্রেণী’। আমি শাসক শ্রেণীর কথা বলেছি। বাংলাদেশের হিন্দুদের মতো মুসলমান বাঙালিরা শাসক শ্রেণীর অংশ। তার অর্থ কি এই যে শেখ হাসিনা, খালেদা জিয়া, এরশাদ এবং তাদের দলের সম্পদশালী ও ধনী ব্যক্তিদের মতো গ্রামের গরিব, কৃষক, শ্রমিক, সাধারণ নিু মধ্যবিত্ত মুসলমান জনগণও শাসক শ্রেণীর লোক? তারা একই শ্রেণীভুক্ত? তাই যদি হয়, তাহলে শাসক শ্রেণী কাকে শাসন করে? এসব খুব মামুলি কথা। এখন যারা এ বিতর্কের নামে আমার ওপর ব্যক্তিগত আক্রমণ করে সমালোচনার নামে গালাগালি করছেন, তাদের চিন্তায় তো এটা নেই যে, শ্রেণী ক্ষেত্রে বাঙালি মুসলমানদের ও বাঙালি হিন্দুদের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। উপরন্তু হিন্দু ধর্মে বর্ণ প্রথার জন্য উচ্চ বর্ণের হিন্দুর সঙ্গে নিুবর্ণের হিন্দুর পার্থক্য আরও বেশি। তাদের মধ্যে শ্রেণীভেদ আরও দুস্তর। সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত, গয়েশ্বর রায় এবং তাদের মতো হিন্দুরা কি বাংলাদেশের শাসক শ্রেণীর লোক নন? তা যদি না হয়, তাহলে যারা এ নিয়ে বিতর্ক করছে, তারা শ্রেণী ও শাসক শ্রেণী বলতে কী বোঝেন?

আমার মূল বক্তব্য এ ক্ষেত্রে হচ্ছে, কোনো ধর্মীয় সম্প্রদায়ের লোকের ওপর নির্যাতন হলে সেটা সাম্প্রদায়িক নির্যাতন হবে এমন কোনো কথা নেই! শ্রেণী নির্যাতনই সব থেকে নিষ্ঠুর নির্যাতন, হিন্দু ধর্মে যার একটা পরিচয় পাওয়া যায় নিু বর্ণের হিন্দু বা দলিতদের ওপর উচ্চ বর্ণের নির্যাতনের মধ্যে। এ নির্যাতন কি বাংলাদেশের উচ্চ বর্ণের হিন্দুরা নিু বর্ণের হিন্দুর ওপর করেন না? গরিব হিন্দু সংখ্যালঘুদের ওপর যে চরম নির্যাতন হয়, এটা অস্বীকার করার প্রশ্ন ওঠে না। দীর্ঘদিন ধরে এ নির্যাতনের বিরুদ্ধে আমি লিখেছি অসংখ্যবার। আমার এসব লেখা আমার অনেক বইয়ের মধ্যে আছে। বেশি আগের কথা বাদ দিয়ে ২০০১ সালের নির্বাচনের পর বিএনপির লোকজন ক্ষমতায় এসে যখন হিন্দুদের বাড়িঘরের ওপর আক্রমণ ও তা লুটপাট করেছিল, তখন আমি তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন দৈনিক পত্রিকায় লিখেছিলাম। ২০১৪ সালের নির্বাচনের ঠিক আগে পাবনা জেলার সাতক্ষীরায় গরিব হিন্দুদের ওপর আওয়ামী লীগের স্থানীয় এমপি ও নেতারা যে আক্রমণ করেছিল, তাদের বাড়িঘর লুটপাট করে তাদের ঘরছাড়া করেছিল, তার বিরুদ্ধেও আমি একইভাবে আমার একাধিক লেখায় প্রতিবাদ করেছিলাম। এসব কথা যে আমাকে এখানে লিখতে হচ্ছে আমার বিরুদ্ধে সাম্প্রদায়িকতার অভিযোগের জবাবে, এটা এ দেশের রাজনীতি, বুদ্ধিবৃত্তির চর্চা ও সংস্কৃতি ক্ষেত্রে এক মস্ত ট্রাজেডি।

বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরও বিপুলসংখ্যক হিন্দু দেশ ত্যাগ করছেন, এটা এক মহাসত্য। কিন্তু আমার বিরুদ্ধে আক্রমণ করতে গিয়ে এ কথা এমনভাবে বলা হচ্ছে যেন হিন্দুদের দেশত্যাগের জন্য আমিই দায়ী! হিন্দুরা বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর কেন দেশত্যাগ করছেন, এটা জিজ্ঞেস করতে হবে আওয়ামী লীগ ও তাদের নেতৃত্বকে। স্বাধীন বাংলাদেশে দেশের শাসনভার তাদের ওপর থাকার সময় এ ঘটনা ঘটলে তার দায়িত্ব কার? ক্ষমতাসীন বাঙালিদের সরকারের, না যে পাকিস্তানিদের এখান থেকে মেরে তাড়িয়ে দেয়া হয়েছিল তাদের? এটা তো এখন বেশ পরিষ্কার, এমনকি হিন্দুদের কাছেও পরিষ্কার, ১৯৭২ সাল থেকেই আওয়ামী লীগের লোকজন, স্থানীয় নেতৃবৃন্দ এবং গুণ্ডাপাণ্ডারা হিন্দুদের সম্পত্তি ব্যাপকভাবে লুটপাট করেছে, তাদের জমিজমা, ভিটেবাড়ি দখল করেছে। এ অপকর্ম যাতে কিছুটা আইনের আওতায় সম্পূর্ণভাবে করা যায় সেজন্য ১৯৭২ সালে শেখ মুজিবের নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকার পাকিস্তানি আমলের ‘শত্রু সম্পত্তি আইন’ ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ রাষ্ট্র বাংলাদেশে উচ্ছেদ না করে ‘অর্পিত সম্পত্তি আইন’ নামে তাকে পুরোপুরিই বহাল রেখেছিল। এভাবে রেখে আওয়ামী লীগের লোকেরা যেভাবে হিন্দু সম্পত্তি লুটপাট ও দখল করেছিল সেটা পাকিস্তানি আমলেও দেখা যায়নি। এছাড়া হিন্দুদের দেশত্যাগের অন্য একটি কারণ হল, ভারতে বর্ণবাদী হিন্দুদের দ্বারা এখানকার হিন্দুদের দেশত্যাগের জন্য উসকানি দেয়া। এ দেশে সাম্প্রদায়িকতার কারণে হিন্দুদের বসবাস অসম্ভব এ কথা অহরহ প্রচার করা। এ উসকানি ও প্রচারণার স্পষ্ট ও প্রকাশ্য প্রমাণ এখন পাওয়া যাচ্ছে ভারতের বিজেপি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিংহের এ মর্মে ঘোষণা থেকে যে, বাংলাদেশ থেকে যে হিন্দুরা ভারতে যাবে শরণার্থী হিসেবে, তাদের স্বাগত জানিয়ে সঙ্গে সঙ্গে ভারতের নাগরিকত্ব দেয়া হবে এবং যে মুসলমানরা যাবে, যেমন আসামে, তাদের সেখান থেকে মেরে তাড়িয়ে দেয়া হবে!! কিন্তু এ প্রসঙ্গে অবশ্য বলা দরকার, হিন্দুদের দেশত্যাগের প্রধান কারণ গরিব হিন্দুদের জমিজমা, ভিটেবাড়ির ওপর আক্রমণ ও তা দখল করা। আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টি প্রত্যেক সরকারের আমলে এটা হলেও আওয়ামী লীগই সব থেকে বড় আকারে হিন্দুদের বিরুদ্ধে এ অপরাধমূলক কাজ করেছে। কিন্তু নানা ঐতিহাসিক কারণে আওয়ামী লীগের সঙ্গে ভারত সরকারের নিকট সম্পর্কের জন্য এখানকার হিন্দুরা বরাবর আওয়ামী লীগকেই ভোট দিয়ে এসেছেন। মাত্র কিছুদিন আগে বিজেপির এক নেতা তথাগত রায় (এখন ত্রিপুরার রাজ্যপাল) বাংলাদেশ সফরে এসে ঢাকেশ্বরী মন্দিরের এক সভায় বলেছিলেন, আওয়ামী লীগকে হিন্দুরা বরাবর ভোট দিয়ে এসেছেন। কিন্তু এখন তাদের উচিত প্রকাশ্য ঘোষণা দিয়ে আওয়ামী লীগের পক্ষে দাঁড়ানো এবং তাকে ভোট দেয়া। বাংলাদেশ রাষ্ট্রে আওয়ামী লীগ হিন্দুদের ওপর সব থেকে বেশি ও বিপজ্জনক নিপীড়নকারী হলেও ভারত সরকারের সঙ্গে আওয়ামী লীগের এ সম্পর্কের কারণে হিন্দুদের মধ্যে দীর্ঘদিন আওয়ামী লীগের চরিত্র সম্পর্কে বিভ্রান্তি থেকেছে। এখনও তা আছে, তবে আগের মতো যে আর নেই এটা এখন বিভিন্ন হিন্দু সংগঠন ও নেতার কিছু বক্তব্য থেকেই দেখা যাচ্ছে।

আমার বিরুদ্ধে ফেসবুকে এখন যারা সব থেকে কুৎসিত ভাষায় বিষোদগার করছে এবং নানা ধরনের মিথ্যা ও বানোয়াট কথাবার্তা বলছে, তারা আওয়ামী ঘরানার লোক ও প্রধানত সিপিবির সঙ্গে সম্পর্কিত। এটা সবারই জানা, তবু গুরুত্বের জন্য এখানে আবার বলা দরকার, আওয়ামী লীগ ও সিপিবি প্রকৃতপক্ষে আদর্শগতভাবে অভিন্ন। পাকিস্তান আমল থেকেই তাদের এ অবস্থা। বাংলাদেশ হওয়ার পর তারা প্রকাশ্যে আওয়ামী লীগের লেজুড়বৃত্তি করে শেষ পর্যন্ত ১৯৭৫ সালে আর কোনো রাখঢাক না করে নিজেদের পার্টিকে বিলুপ্ত ঘোষণা করে শেখ মুজিবের নেতৃত্বাধীন ফ্যাসিস্ট রাজনৈতিক দল বাকশালে যোগদান করেছিল। বাকশালের কেন্দ্রীয় কমিটিতে তাদের নেতা মণি সিং সামরিক বাহিনীর জেনারেল শফিউল্লাহ, জিয়াউর রহমান, পুলিশের আইজি, উচ্চপর্যায়ের আমলা এবং আওয়ামী লীগ নেতাদের সঙ্গে বসে সেই ফ্যাসিস্ট দলটির গৌরব বৃদ্ধি করেছিলেন। তাদের ‘মার্কসবাদী’ চিন্তাধারায় বাকশালকে আলোকিত করেছিলেন!! ১৯৭৫ সালের আগস্টে শেখ মুজিবের হত্যা এবং বাকশাল উচ্ছেদ হওয়ার পর জিয়াউর রহমানের আমলে রাজনৈতিক দল পুনরুজ্জীবিত হওয়ার সময় আওয়ামী লীগ ও সিপিবি উভয়েই বাকশালের গর্ভ থেকে পুনর্জন্ম লাভ করেছিল যমজ ভাই হিসেবে। দল হিসেবে স্বতন্ত্র হলেও তারা উভয়েই ‘মুজিববাদী’ আদর্শের দ্বারা অনুপ্রাণিত ও তার অনুসারী। এ কারণে বাকশালের গর্ভ থেকে বের হয়ে আসার পর সিপিবির নামকরণ যথার্থভাবে হয়নি। তার নামকরণ হওয়া দরকার ছিল সিপিবি (মুজিববাদী)। আওয়ামী লীগ ও মুজিববাদী সিপিবি এখন প্রমাণ করতে উঠেপড়ে লেগেছে যে, বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িকতার এক প্রবল আবহ তৈরি হয়েছে, হিন্দুরা এ সাম্প্রদায়িকতার নির্যাতনে অতিষ্ঠ ও আতংকিত হয়ে দিন কাটাচ্ছে, অনেকে দেশত্যাগ করছে! তারা নিজেরাই যে হিন্দুদের ওপর সব থেকে বড় নির্যাতক এ কথা ধাপাচাপা দেয়ার জন্যই তারা এসব করছে এবং হিন্দুদের ওপর নির্যাতনকে তার পরিপ্রেক্ষিত থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন করে একে আখ্যায়িত করছে সাম্প্রদায়িকতা হিসেবে। নির্যাতন হলেই যে তা সাম্প্রদায়িক হবে, তার অন্য কোনো চরিত্র থাকবে না বা থাকতে পারে না, এ বক্তব্য হাজির করে তারা নিজেদের লুটতরাজ ও হিন্দু নির্যাতনের বিষয়টিকে সাম্প্রদায়িক হামলা ও নির্যাতন আখ্যা দিয়ে দেশের জনগণের বিরুদ্ধেই কুৎসা রটনা করছে।

তাছাড়া সাম্প্রায়িকতার কথা যদি বলা হয়, তাহলে বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িকতা থাকলে এখানে মুসলিম লীগের মতো সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক দল থাকত? সেরকম কিছুই নেই। জামায়াতে ইসলামী এবং তাদের মতো অন্য দলগুলো হল মৌলবাদী টার্গেট হিন্দুরা নয়। টার্গেট হল কমিউনিস্ট, সমাজতন্ত্রী, যে কোনো ধরনের প্রগতিশীল। আওয়ামী লীগ কিসের অসাম্প্রদায়িক? এটা ঠিক, এরশাদ রাষ্ট্রধর্ম করেছিলেন। কিন্তু শুধু বিএনপি বা জামায়াতে ইসলামীই নয়, আওয়ামী লীগ তার তিনদফা সরকারের আমলে কি সে আইন বাতিল করেছে, না সেটা বহাল রেখেছে একইভাবে? পঞ্চদশ সংশোধনীতে ভেল্কিবাজি দেখিয়ে একদিকে তারা বাংলাদেশকে বলেছে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র, আবার অন্যদিকে তারা বহাল রেখেছে রাষ্ট্রধর্ম ইসলামকে!! সিপিবি (মুজিববাদী)ও এদিক দিয়ে একই গর্তের শেয়াল। কাজেই বিস্মিত হওয়ার কিছু নেই, আমি হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকদের ওপর যে নির্যাতন এখন হচ্ছে তাকে সাম্প্রদায়িক না বলে শাসক শ্রেণীর লোকদের সম্পত্তি, জমিজমা দখল, দুর্নীতি এবং অপরাধমূলক তৎপরতা বলে আখ্যায়িত করায় তাদের গায়ে জ্বালা ধরেছে। তাদের লেজে আগুন লেগেছে। আমার বক্তব্যের মর্মার্থ বোঝার ধারেকাছে না গিয়েই বিতর্কের নামে তারা আমার বিরুদ্ধে তৎপর হয়েছে। শুধু শব্দ নয়, আমার কোনো কোনো বাক্য পর্যন্ত মোচড় দিয়ে তারা আমার বক্তব্যের যুক্তিকে ক্ষতিগ্রস্ত এবং অর্থকে বিকৃত করেছে। আওয়ামী লীগের মধ্যে শিক্ষিত লোকের নিদারুণ অভাবের কারণে সিপিবি দীর্ঘদিন ধরে আওয়ামী লীগের সাংস্কৃতিক অঙ্গসংগঠন বা Cultural Wing হিসেবেই কাজ করে এসেছে। আমার বিরুদ্ধে তাদের লোকজনই এখন নানা ধরনের কুৎসা প্রচার করে আওয়ামী লীগের ‘সাম্প্রদায়িক’ চরিত্র আড়ালের চেষ্টা করছে। তাদের এ ‘সাম্প্রদায়িকতার’ সঙ্গে বাংলাদেশের জনগণের কোনো সম্পর্ক নেই।

বাংলাদেশে ‘হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ’ নামে যে সংগঠনটি আছে তার মধ্যে বৌদ্ধ ও খ্রিস্টানদের উপস্থিতি নামমাত্র। এটা আসলে উচ্চ বর্ণের হিন্দুদের একটি সাম্প্রদায়িক সংগঠন। এ সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক রানা দাশগুপ্ত বাংলাদেশে হিন্দুদের বিরুদ্ধে সাম্প্রদায়িক আক্রমণ বন্ধের জন্য ভারতের পিটিআইকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর কাছে আহ্বান জানিয়েছেন। আওয়ামী লীগের কোনো কোনো নেতা এবং অন্যরা এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করায় রানা দাশগুপ্ত পিটিআইয়ের এ রিপোর্টকে মিথ্যা বলেছেন। কিন্তু পিটিআই এরপর বেশ জোরের সঙ্গেই বলেছে, রানা দাশগুপ্ত যা বলেছেন তারা সেটাই রিপোর্ট করেছে। তাদের কাছে নিশ্চয়ই সাক্ষাৎকারের রেকর্ডকৃত ভাষ্য আছে। কাজেই পিটিআইয়ের এ দাবিতে তিনি কোনো প্রত্যুত্তর দেননি। এ ক্ষেত্রে যা লক্ষ করার বিষয় তা হল, রানা দাশগুপ্ত যা চেয়েছেন তাই হয়েছে। কলকাতার আনন্দবাজার পত্রিকার এক রিপোর্টে বলা হয়েছে, ঢাকার রামকৃষ্ণ মিশনের স্বামীজীকে কোনো এক সূত্র থেকে হুমকি দেয়ার পর ভারতের প্রধানমন্ত্রী এ বিষয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। মিশনের সন্ন্যাসীদের নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করার জন্য উদ্যোগী হয়েছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। (যুগান্তর, ১৮.০৬.২০১৬)। এসব থেকে বোঝার অসুবিধে নেই যে, ভারতের বিজেপি সরকার ও বাংলাদেশে আরএসএস ও বিজেপি মার্কা উচ্চ বর্ণের কিছু হিন্দু একজোট হয়ে বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িকতা প্রচার করছে এবং এ সূত্র ধরে বাংলাদেশে ভারতের হস্তক্ষেপের শর্ত তৈরি করছে।

ভারতে যেমন চরম সাম্প্রদায়িকতা আছে, আছে নিুবর্ণের হিন্দু বা দলিতদের ওপর উচ্চ বর্ণের হিন্দুদের প্রধান অংশের ভয়াবহ নির্যাতন, তেমনি সেখানে আছে এসবের বিরুদ্ধে শক্তিশালী প্রতিরোধ আন্দোলন। সেখানে আছেন এর বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে সাংগঠনিক ও ব্যক্তিগতভাবে সংগ্রাম ও প্রতিবাদ করার মতো অসংখ্য প্রগতিশীল মানুষ- লেখক, সাহিত্যিক, শিল্পী, রাজনৈতিক ব্যক্তি। সম্প্রতি নরেন্দ্র মোদির চরম সাম্প্রদায়িক নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে ৪৫ জন সাহিত্য একাডেমি পুরস্কার পাওয়া লেখক এবং আরও অনেক শিল্পী তাদের পুরস্কার ফেরত দিয়েছেন এবং সেই সঙ্গে ফেরত দিয়েছেন সুদসহ তার বাবদ প্রাপ্ত অর্থ। বাংলাদেশে যারা নানা ধরনের বড় বড় পুরস্কার পেয়েছেন, শিল্পী, সাহিত্যিক, লেখক, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব নামে পরিচিত ব্যক্তি, তারা কি আওয়ামী লীগের চরম ফ্যাসিস্ট নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে নিজেদের পুরস্কার ফেরত দিতে পারেন? এ রকম একজনও কি আছেন? শুধু তাই নয়, বাংলাদেশে তদবির করে পুরস্কার পাওয়ার একটা ব্যাপার আছে যা ভারতে নেই। ভারতে যারা পুরস্কার পান তারা নিজেদের যোগ্যতার ভিত্তিতেই সেটা পেয়ে থাকেন। এ বছর স্বাধীনতা পুরস্কার ঘোষণার পর এক লব্ধপ্রতিষ্ঠিত কবি পুরস্কার না পেয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে নির্লজ্জভাবে শেখ হাসিনার কাছে পুরস্কার দাবি করেছিলেন! হাসিনা সে দাবি মঞ্জুর করে তাকে পুরস্কার দিয়েছেন!! যারা এভাবে পুরস্কার পান তারা কবি সাহিত্যিক হিসেবে যতই গুণী হন, তাদের চরিত্রের খবর কী? যা হোক, এ প্রসঙ্গে এটা বলা দরকার, ভারতে কোনো গুরুতর বিষয়ে বিতর্ক হলে সে বিতর্কে সাধারণভাবে বিতর্কের ব্যাকরণ ও নিয়ম-কানুন মান্য করেই তা করা হয়। এখানে তার সম্পূর্ণ উল্টো ব্যাপার। এখানে মননশীলতার চর্চা, সিরিয়াস চিন্তাভাবনা, ব্যক্তিগত স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে চিন্তার কোনো ঐতিহ্য যে এখনও পর্যন্ত সৃষ্টি হয়নি, এটা আমার বিরুদ্ধে ফেসবুকে সমালোচনার নামে যে গালাগালি হচ্ছে তার থেকেই বোঝা যায়।

এরপর একটি বিষয়ের সংক্ষিপ্ত উল্লেখ করে এ আলোচনা শেষ করব। ‘বাংলাদেশে প্রকৃত সংখ্যালঘু কারা?’ নামক প্রবন্ধে আমি সংখ্যালঘু সমস্যার ওপর যে আলোচনার সূত্রপাত করেছিলাম, তার কোনো দেখা এসব বিতর্কের মধ্যে নেই। হিন্দুদের ওপর নির্যাতনকে কেন আমি সাম্প্রদায়িক নির্যাতন বলছি না, এটাই হল এসব লেখার উত্তেজিত বক্তব্য। যারা এভাবে বিতর্ক করেছেন তারা যে বাংলাদেশে সব থেকে নিপীড়িত জাতিগত ও ভাষাগত সংখ্যালঘুদের বন্ধু নন, এটা তারা এ প্রসঙ্গ তাদের আলোচনায় উহ্য রেখেই প্রমাণ করেছেন। এর মূল কারণ হিন্দুরা জাতিগতভাবে বাঙালি এবং মুসলমানদেরই জাতভাই যা অন্যেরা নয়। বাঙালি উচ্চ ধর্মের হিন্দুরা এখানকার শাসক শ্রেণীর অংশ। কাজেই সাঁওতাল, হাজং, রাখাইন, চাকমা, মারমা, ত্রিপুরার ওপর নির্যাতন এদের কাছে বিবেচনার বিষয় কীভাবে হতে পারে? কিন্তু বাংলাদেশে জনগণের গণতান্ত্রিক সংগ্রাম সংগঠিত করার ক্ষেত্রে সংখ্যালঘু সমস্যার প্রকৃত বিশ্লেষণ এবং প্রকৃত ও সব থেকে নিপীড়িত সংখ্যালঘুদের স্বার্থ রক্ষার জন্য সংগ্রাম অপরিহার্য। এ কর্তব্যবোধের কোনো দেখা আমার বিরুদ্ধে আক্রমণকারীদের বক্তব্যের মধ্যে পাওয়া গেল না।

বুধবার, ৬ এপ্রিল, ২০১৬

কাব্যি করার চেষ্টা ২

রাস্তা বেয়ে ওঠা সময়ের অপচয়গুলো চেপে বসে মাথায়
বুকের গভীরে জমে ণোনাজল তারপর
ঝাপসা হয়ে যায় আশপাশ।

মঙ্গলবার, ৫ এপ্রিল, ২০১৬

কাব্যি করার চেষ্টা ১

দেয়ালের গায়ে কাজগুলো ঝুলছে
গলে পড়ছে সময়
আত্মহত্যাগামী জীবনচক্রের ভেতর আমি অথবা আমরা
আত্মমগ্নই থেকে যাই।