মঙ্গলবার, ২৯ আগস্ট, ২০১৭

বলবো না

তখন সবে হাই স্কুলে পা দিয়েছি। শীতের মধ্যে সকাল সকাল লেপের নিচ থেকে উঠতে কি যে কষ্ট হতো। হাতমুখ ধোয়ার জন্যে পুকুরের সামনে দাঁড়াতেই মনে হতো ঝেড়ে একটা দৌড় দিয়ে আবার লেপের মধ্যে গিয়ে ঢুকি। অবশ্য মায়ের রুদ্রমূর্তিটা মনে পড়ত বলে তেমনটা করা হতো না কখনোই।
গরম ভাতের সাথে কোন দিন বর্তা, কোন দিন ভাঁজি অথবা ডাল এই দিয়ে খেয়েদেয়ে তৈরি হয়ে বেরিয়ে পড়তাম স্কুলের জন্যে। ঈদগার কাছাকাছি এসে সবার সাথেই দেখা হতো। তারপর পাখির মত দল বেঁধে আনন্দগুলো ভাগাভাগি করে কাটিয়ে দিতাম সারাটা দিন। এটাই যেন নিয়ম হয়ে গিয়েছিল আমাদের। কিন্তু নিয়ম তো ভাঙার জন্যেই।

একদিন সকালের কথা। ঘুম ভাংতেই দেখি মা বাবার মাথার কাছে কপালে হাত দিয়ে বসে কাঁদছে। বাবা শুয়ে আছে। মাঝে মাঝে কোকীয়ে উঠছে, ব্যথায়। তখন হাঁটুগুলো অনেকটা ভাজ করে উপরে নিয়ে আসছে, কুচকে ফেলছে চোখ, দু’হাত দিয়ে খামছে ধরছে পেট। আমি বুঝতে পারলাম ব্যথাটা পেটে।
ধীরে ধীরে বাবা কিছুটা শান্ত হয়ে এলো। মা উঠে গেল পাশের ঘরে। আমি পাশেই বসে ছিলাম। হঠাৎ বাবা বালিশ থেকে মাথাটা একটু তুলে বলল – ‘গায়ে কোথাও পচন ধরলে কেমন লাগে জানিস?’ আমি এমন প্রশ্ন কোনদিন শুনিনি। জিজ্ঞেস করলাম – ‘কেমন লাগে বাবা?’ বাবা ছলছল করা চোখ নিয়েও মুচকি হেসে বলল – ‘বলবো না’।

তার কিছুদিন পর, আমি তখন আর স্কুলে যাই না সারাদিন বাবার পাশেই বসে থাকি। বাবা সারাদিন শুয়ে থাকে, কখনো গলা দিয়ে গড়গড় শব্দ করে নিজেই জেগে উঠে কাশতে শুরু করে, মা পাশ থেকে গরম পানির গ্লাসটা এগিয়ে দেয়। আমি পাশে বসে থাকি। বাবাকে চামচ দিয়ে জাও খাইয়ে দেওয়া হয়, আমি পাশে বসে থাকি। নিয়মিত মানুষের আনাগোনা হয় বাড়িতে, আমি পাশে বসে থাকি। কখনো কখনো বাবা পেটটা খামছে ধরে চিৎকার করে ওঠে ব্যথায়, মা বাবাকে জাপতে ধরে মাথাটা বুকের কাছে নিয়ে ফুঁপিয়ে ওঠে, আমি কেঁদে উঠি।

একদিন বাড়িটা খুব বেশি নিরব হয়ে গেল। মা একটু পর পর ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠছে, সাথে কিছু নিকটাত্মীয়রাও। কেউ কেউ দোয়া পড়ছে। এত মানুষ তবুও বেশি আওয়াজ নেই বাড়িটায়। বাবা আজ চিৎকার করছে না, শুধু একটানা গুঙিয়ে চলেছে। গড়গড় আওয়াজ হচ্ছে গলা থেকে। একটু পর পর মুখের ভেতরটা রক্তে ভোরে উঠছে, যখন উপচে পড়ছে গাল বেয়ে তখন মুছিয়ে দিচ্ছে কেউ। আমি পাশে বসে আছি।
সেদিন সন্ধ্যায় যখন গ্রামটা নিয়মমাফিক নীরব হয়ে গেল, বাবার প্রিয় পূর্ণিমার চাঁদটা যখন তার সবটুকু আলো ঢেলে দিচ্ছিল আমাদের গ্রামে তখন কি হয়েছিল জানো?
বলবো না।

মানব ইতিহাসে ছাগলের অবদান!

ছাগল। মাংস, দুধ, চামড়া, বাচ্চা-কাচ্চা সর্বস্ব উজাড় করে দিয়ে উপকার করছে আমাদের। কিন্তু এখানেই শেষ নয়। মানব ইতিহাসে এক বিশাল অবদান রেখেছে এই ছাগল!

৮৫৮ খ্রিস্টাব্দ। কালদি নামের ইথিওপিয়ার এক ছাগল পালক, প্রতিদিনের মতো সেদিনও গিয়েছেন ছাগল চরাতে। ছাগলগুলোকে চরতে দিয়ে সে চলে গেছে আরাম করতে। দুপুরের দিকে ঘুমিয়েও পরেছিল একটু। বিকেলে জেগে উঠে আবার বাঁশিতে ফুঁ। এবারে সেই সুর, যা সে প্রতিদিনই বাজায় ছাগলের পালকে তাঁর কাছে ফিরিয়ে আনার জন্য। এই সুর শুনেই ছাগলগুলো তার কাছে ফিরে আসে এবং বাড়ির পথ ধরে। কিন্তু সেদিন ছাগলগুলো এলোনা। চিন্তিত হয়ে পড়ল কালদি। খুঁজতে শুরু করল।

একটুক্ষণ খুঁজেই পেয়েগেল ছাগলগুলো। কিন্তু সমস্যা হল, ব্যপক লাফালাফি শুরু করেছে ছাগলগুলো। দেখে বুঝারও উপায় নেই যে দিনভর এগুলো পুরো ভূমিতে চরেবেড়িয়েছে। আজ এদের যেন কোন ক্লান্তিই নেই! ব্যপারটা বুঝার চেষ্টা করল কালদি। খেয়াল করল, ছাগলগুলো ইথিওপিয়ার ঝোপ থেকে এক ধরণের ছোট ছোট লাল ফল খাচ্ছে আর তুমুল উৎসাহে লাফালাফি করে যাচ্ছে। কৌতূহলী হয়ে উঠলো কালদি। দু’তিনটা ফল হাতে তুলে নিল, ঘুড়িয়েফিরিয়ে দেখল। মুখে পুরে দিল। খেয়ে নিল। কিছুক্ষণের মধ্যেই ব্যপক চাঙ্গা হয়ে উঠলো কালদির শরীর। সে বুঝতে পারলো এটাই তাহলে ছাগলদের উৎসাহী হয়ে উঠার উৎস।

কিছু ফল সংগ্রহ করে ছাগলগুলো নিয়ে কালদি চলে এলো গ্রামে। গ্রামের লোকেদের ঘটনাটা বলল। তারপর সবাই মিলে ফলগুলোকে ফুটিয়ে পানিয় তৈরি করে পান করল। এবারে কাঁচা ফল খাওয়ার থেকেও বেশি উৎফুল্লতা অনুভব হল। ব্যস, শুরু হয়ে গেল কফি খাওয়া।

হ্যাঁ, এতক্ষণ কফি আবিষ্কারের ইতিহাসই বলছিলাম। আর সেই লাল ফলটা হচ্ছে কফি ফল। এই ইতিহাস এখনো ঘুরে বেড়ায় ইথিওপিয়ার মানুষের মুখে মুখে।

ভাবুন একবার, এক পাল ছাগল কিনা আবিষ্কার করে বসল পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম বিক্রিত পণ্য যা বিশ্বের সর্বাপেক্ষা বেশি পানকৃত পানীয়গুলোর মধ্যে অন্যতম। প্রায় ৭০টি দেশে এই ফলের গাছ জন্মে। ২০১০ সালে ৭ মিলিয়ন টন কফি উৎপাদিত হয়েছে সারা পৃথিবীতে। আর হ্যাঁ ভারত, ব্রাজিল, ভিয়েতনাম, ইন্দোনেশিয়ায় কিন্তু আজও ছাগলরা কফি ফল খায়!

খানাপিনা

আপনি যদি নিজেকে সাধারণ ও সাভাবিক মানুষ বলে মনে করেন তবে আপনার জেনে রাখা উচিৎ যে, একজন মানুষ গড়ে তার সারা জীবনে ৬০,০০০ পাউন্ড খাবার খায় যা কিনা ছয়টা হাতির সারা জীবনের খাবারের সমান!
এতো গেল তথ্যের কথা এবার চলুন ঘটনায়। ঈশ্বরচন্দ্ৰ বিদ্যাসাগর ছিলেন অত্যন্ত ভোজন রসিক। তিনি যেমন খেতে ভালোবাসতেন তেমনি খাওয়াতে। মাঝেমধ্যেই তিনি তার বন্ধুদের রেঁধে খাওয়াতেন আর পরিবেশনের সময় ছড়া কাটতেন –
‘হুঁ হুঁ দেয়ং হাঁ হাঁ দেয়ং দেয়ঞ্চ করকম্পনে
শিরসি চালনে দেয়াং ন দেয়ং ব্যাঘ্ৰঝম্পনে ৷’
এহেন বিদ্যাসাগর একবার তার বন্ধুদের নিয়ে একটা সংগঠনই করে ফেললেন, নাম রাখলেন ‘ভোজনসভা’। এই সংগঠনের কাজ হচ্ছে চেনা পরিচিতদের বাড়িতে হঠাৎ হামলা করে খাওয়ার আবদার করে বসা। এই সংস্থার নাম ছড়িয়ে পড়েছিল ঘনিষ্ঠ মহলে। তাই প্রত্যেকেই সদা প্ৰস্তুত থাকতেন – এই বুঝি এল ভোজনসভার সভ্যারা!
একবার ঘটল এক কান্ড। ভোজনসভার সভ্যরা দল বেঁধে এক বন্ধুর বাড়িতে বেশ ঘটা করে খাওয়া দাওয়া করলেন। খাওয়া-দাওয়ার পরের দিন সংস্থার এক সদস্যের পেটের অসুখ হল। বেশ কয়েকদিন তার দেখা নেই। কিছুদিন পর সুস্থ হয়ে সদস্যটি এলেন ভোজনসভায়। বন্ধুরা তাঁকে নিয়ে ঠাট্টা-তামাসা করতে লাগলেন । তার উদ্দেশ্যে সবাই বললেন, এ বড় পেট-রোগা! ভোজনসভার সভ্য হওয়ার উপযুক্ত নয়। একে সংস্থা থেকে বাদ দেওয়া উচিত।
এতক্ষণ চুপ ছিলেন বিদ্যাসাগ। হঠাৎ তিনি হাসতে হাসতে বললেন, ‘না হে না, তোমরা ঠিক বলছ না, ওই তো আমাদের মধ্যে একমাত্র সভ্য যে আদর্শের জন্য জীবন পর্যন্ত দিতে উদ্যত । ওকে ভোজনসভা থেকে কোনো মতেই বাদ দেওয়া যায় না।’
আরও একটা ঘটনা বলি, চারশ বছর আগের ঘটনা। রানি প্রথম এলিজাবেথ তার বাবুর্চিকে প্রথমবারের মত আলু দিয়ে তরকারি রান্নার হুকুম দিলেন। অথচ বাবুর্চি বেচারা জীবনে আলু চোখেই দেখেনি। যারফলে রান্নার সময় বাবুর্চি ভীষণ ঘাবড়ে গিয়ে আলুর গাছটা রেখে আলুকে আবর্জনা মনে করে ফেলে দিয়েছিল!
অনেক হল খাবার নিয়ে খচখচানি এবার কিছু তথ্য দিয়ে শেষ করব – জাতিসঙ্ঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (ফাও) এবং বাংলাদেশ সরকারের যৌথ ব্যবস্থাপনায় গড়ে তোলা দেশের সর্বাধুনিক খাদ্য নিরাপত্তা গবেষণাগারের পরীক্ষায় যানা গেছে – ‘বাংলাদেশের শতকরা ৪০ ভাগ খাদ্যপণ্যই ভেজাল!’
এদেশের ১৬ ভাগ মানুষ কিডনি রোগে আক্রান্ত। রাসায়নিক পদার্থ মিশ্রিত খাদ্য গ্রহণের ফলে এ রোগ বাড়ছে। প্রতিবছর প্রায় ৪৫ লাখ মানুষ খাদ্যে বিষক্রিয়ার ফলে বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হচ্ছে।
খাদ্যে ভেজাল মিশানোর অপরাধ হিসেবে ভারতে সাজা যাবজ্জীবন; চীনে মৃত্যুদণ্ড, পাকিস্তানে ২৫ বছরের কারাদণ্ড, যুক্তরাষ্ট্রে সশ্রম কারাদণ্ডের বিধান রয়েছে। আমাদের দেশে এ বিষয়ে আইন আছে, কিন্তু তার যথাযথ প্রয়োগ নাই।
নতুন প্রণীত নিরাপদ খাদ্য আইন – ২০১৩ তে জরিমানা ও শাস্তির পরিমাণ বাড়িয়ে ৫ বছর কারাদণ্ড বা অনধিক ১০ লক্ষ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডের বিধান রয়েছে। কিন্তু বাস্তবে এর প্রয়োগ খুবই কম চোখে পড়ে।

আঙুর ফল টক

অনেক দিন পরে সুবর্ণার সাথে দেখা। একটা বিয়ের অনুষ্ঠানে। সাথে ওর স্বামী আর চার-পাঁচ বছরের একটা বাচ্চা। মোটামুটি আগের মতই দেখতে এখনো। তবে শরীরটা কিছুটা ভারি হয়ে গেছে। খেয়াল করলাম হাঁটার সময় কেমন হাঁসের মত হেলেদুলে হাঁটছে। দেখতে খারাপ লাগছে না ব্যপারটা। কিন্তু ওর হাঁটা দেখলেই বারবার ‘দোল দোল দুলুনি’ গানটা মনে পড়ছে।
ওই প্রথম আমাকে দেখে ডাকল – ‘সুমন, এই সুমন’।
খালি পকেটে রাস্তায় বেরিয়ে দুশো টাকা কুড়িয়ে পেলে যেমন অদ্ভুত আনন্দ হয় ওকে দেখার পর আমারও সেরকম আনন্দ হল। ‘আরে তুমি এখানে’? চোখ-মুখে বিস্ময় নিয়েই জিজ্ঞেস করলাম।
‘হু, কতদিন পরে দেখা তাই না’?
‘হ্যাঁ’…
অনেকক্ষণ চলল আমাদের কথা। আমাকে ওর স্বামীর সাথে পরিচয় করিয়ে দিল আর বাচ্চাটির সাথে আমাকে পরিচয় করিয়ে দিল মামা বলে। ভাবা যায়! অথচ এই সুবর্ণাকেই আমি একদিন কত চাইতাম মনে মনে।
ওর বাচ্চাটি বেশ চঞ্চল প্রকৃতির। এক যায়গায় স্থির থাকতেই রাজি নয়। তাই ওর স্বামী হাঁটার জন্য বাচ্চাটিকে নিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে গেল। আমরা দুজনে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলাম। সুবর্ণার চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকাতে আমি ভাবলাম এবার আমার যাওয়া উচিৎ। কিন্তু হঠাৎ ওই নিরবতা ভাংল – ‘মনে আছে ভার্সিটিতে তুমি আমার কাছ থেকে বই ধাঁর নিয়ে পড়তে’?
‘বই না নোট। তুমি অযথাই বইগুলো দিয়ে পড়তে বলতে।’
‘তুমি কোনদিন পড়নি বইগুলো, তাইনা?’
‘স্বাভাবিক’, আমি বিষয়টা বুঝানোর চেষ্টা করলাম। ‘নোট পড়লেই যেখানে ল্যাঠা চুকে যাচ্ছে বই পড়তে যাব কেন?’
‘না পড়ে যদি একবার খুলেও দেখতে বইগুলো তবে আমি হয়তো এই অনুষ্ঠানে তোমার সাথেই আসতাম’।
এরপর আমি আর বলার মত কোন কথা খুঁজে পাচ্ছিলাম না। তেমন সুযোগও হয়নি অবশ্য। ওর স্বামী বাচ্চাটাকে নিয়ে চলে এসেছিল। তাই ফর্মালি বিদায় নিয়ে নিলাম। আসতে আসতে নিজেকে সান্তনা দিচ্ছিলাম এই বলে যে – ‘বরাবরই আমার সাহসি মেয়ে পছন্দ, যে মেয়ে সাহস করে ভালোবাসার কথা বলতে পারে না তাকে বিয়ে না করে ভালোই হয়েছে; ও আসলে একটা কানারী (কাপুরুষের বিপরীত লিঙ্গ)’।
এসব ভাবতে ভাবতে হঠাৎ বউয়ের ফোন – ‘তুমি বিয়ে খেতে গেছ না করতে গেছ, আমি হাসপাতালে প্রেগন্যান্ট হয়ে পরে আছি আর সে রাসলীলা শুরু করেছে; আয় শুধু তুই একবার’।

বিবাহোত্তর কাব্য

শেষমেশ বিয়েটা করেই ফেলল ওরা, সেটাও দু’বছর আগের কথা। অবশ্য এটাই স্বাভাবিক ছিল। সকল প্রেমই একটা পরিনতি চায় আর সেই পরিণতিটা হচ্ছে বিয়ে। কথায় আছে বিয়ে একশ কথা নিয়ে। ওদের বিয়েতেও তাই হয়েছিল। অনেকেই রাজি ছিলনা শুরুর দিকে। কিন্তু পাত্র-পাত্রী নিজেরাই যেহেতু উদ্যোগী হয়ে মাঠে নেমে পড়ল তাই নিমরাজি সদস্যদের আর করার কিছুই থাকল না। ভালোয় ভালোয় বিয়ের ব্যপারটা উতরেও গেল। এর মধ্যে দেখতে দেখতে দুটি বছরও কেটে গেছে।
সব ঠিকঠাকই চলছিল কিন্তু এদানিং পাত্রী মানে বর্তমানে যিনি স্ত্রী, তার বেশ অভিমান হতে দেখা যায়। তার অবশ্য বেশ জোড়াল কারণও আছে, বিয়ের আগে পাত্র মানে বর্তমানে যিনি বর, নিয়ম করে স্ত্রীর জন্যে কবিতা লিখত, সেগুলো আবার ফেসবুক মেসেঞ্জারে পাঠিয়েও দিত। প্রথম প্রপোজটাও কিন্তু কবিতা দিয়েই হয়েছিল। আমাদের গল্পের বর তার স্ত্রীকে লিখেছিল –
যদি অনুমতি দাও তবে কাছি আসি
বলতে চাই, ভালোবাসি, ভালোবাসি, ভালোবাসি…
আর আজকাল? কাব্য টাব্য সব শিকেয় উঠেছে। বরটি কিইবা করবে? এখন তো আর একা নয় যে প্রোমোশনের চিন্তা বাদ দিয়ে কোনরকমে চাকরীটা করবে আর সঙ্গিনীর জন্যে কবিতা লিখবে। এখন তাকে ভাবতে হয় ভবিষ্যতের কথা। তাই চাকরীটাও খুব সিরিয়াসলি করতে হয়। নিয়মিত বসকে তেল দিতে হয়। অন্য কলিগদের খুশী রাখতে হয়, যদিও ওদের টপকেই ওকে প্রোমোশন নিতে হবে! বাট কিছু করার নেই, এটাই লাইফ।
তো যাইহোক, এই অবস্থায় আর কবিতা কোথা থেকে আসে? তবুও স্ত্রীর বায়না বলে কথা। মেটাতে তো হবেই। তাই কথা দিল রাতে লিখে রাখবে, সকালে অফিসে যাওয়ার সময় কবিতা লেখা চিরকুটটা টেবিলে রেখে যাবে। ও বেরিয়া যাওয়ার পর যেন সেটা খুলে পড়ে নেয়।
সকালে বর বেড়িয়ে যাওয়ার পর দৌড়ে রিডিং টেবিলের সামনে চলে এল স্ত্রী। টেবিলে রাখা চিরকুটটি হাতে তুলে নিল। ভাজ খুলেই দেখতে পেল সেই পুরনো প্রিয় অক্ষরগুলোকে। অতীতের সেই দিনগুলোর কথা মনে পড়ে যাচ্ছে ওর। হাসি হাসি মুখে পড়তে শুরু করল চিরকুটটি। তাতে লেখা –
তুমি আমার ময়না পাখি
তুমি আমার টিয়া
জনমের মত দিয়াছ আছোলা
করিয়া আমারে বিয়া
(বাকিটুকু ইতিহাস…)

জলে ভাসা দ্বীপ

চৌদ্দ শতকের আগ পর্যন্ত দক্ষিন আমেরিকার উরু (Uru) জাতীগোষ্টির লোকেরা হ্রদের কিনারে কাঠ, খড়, ছন ইত্যাদি দিয়ে নিজেদের তৈরি নৌকাতেই বসবাস করত; অনেকটা আমাদের দেশের বেদে সম্প্রদায়ের মতই। ডাঙায় বিচরণ আর নৌকায় ঘুম এই করে ভালোই কাটত যদি এমারা ইন্ডিয়ানরাও (Aymara Indians) একই এলাকায় বসবাস না করত। এমারা ইন্ডিয়ানরা ছিল দাঙ্গা হাঙ্গামায় উরুদের চেয়ে বেশি শক্তিশালী। তাই এমারা ইন্ডিয়ানদের সাথে উরুদের নিয়মিত ঝামেলা-মারামারি লেগেই থাকত। শেষমেশ এমারাদের সাথে না পেরে নিজেদের পুরোপুরি জলে নিয়ে যেতে বাধ্য হল উরু’রা।
উরুদের তৈরি নৌকায় উরু রমণী
চৌদ্দ শতকের শুরুর দিকের কোন একটা সময় উরু’রা বাসস্থান হিসেবে বেছে নিল ভাসমান দ্বীপ যা তারা তৈরি করেছে টিটিকাকা (Titicaca) হ্রদের উপর। ধীরে ধীরে বাড়তে থাকল দ্বীপের সংখ্যা। দ্বীপ তৈরির মূল উপাদান আঁখ গাছ। মজবুত করার জন্য ব্যবহার করা হয় গাছের ডালপালা, মূল আর কাণ্ড। শুধু দ্বীপ নয় উরুদের বাড়ি এমনকি তাদের ব্যবহারের নৌকাও আঁখ গাছ দিয়ে তৈরি।
আঁখ গাছ পানিতে দ্রুত পোঁচে যায় তাই নির্ধারিত ব্যক্তিরা নিয়মিত ভাবে প্রতি মাসে আঁখ গাছ পরিবর্তনের কাজটি করে থাকে।
এতো গেল উরু দের কথা এবার আসি মেক্সিকোর রিচার্ট সোয়া নামের এক ভদ্রলোকের কথায়। যিনি নিজের জন্য একটি ভাসমান প্রাসাদ বানিয়েছেন ইসলা মুখেরেস এ! শুধু ভাসমান হলেও নাহয় কথা ছিল, দ্বিপটি তিনি বানিয়েছেন প্রায় দেড় লক্ষ পুনর্ব্যবহৃত প্লাস্টিকের বোতল দিয়ে!
ভাসনাম জোয়েক্সি আইল্যান্ড 
ইন্টারনেট কানেকশন, বৃষ্টির পানি ধরে রাখার সরঞ্জাম, বিদ্যুতের জন্য সোলার প্যানেল, ওয়াশিং মেশিন, গোসলের জন্য জাকুজি ইত্যাদি আধুনিক সুযোগ সুবিধা সহ দ্বিপটি বানাতে তার সময় লেগেছে সাত বছর। তিনি দ্বীপের নাম দিয়েছেন ‘জোয়েক্সি আইল্যান্ড’৷
ব্যক্তি উদ্যোগে তৈরি ভাসমান দ্বীপের উদাহরণ কিন্তু আরও আছে, এই যেমন – কানাডার ভ্যাঙ্কুভারের উপকূলে ‘ফ্রীডম কৌভ’ বা ‘স্বাধীন দ্বীপ’। যেটি তৈরি করেছে ওয়েন অ্যাডামস (৬৬) এবং ক্যাথিরিন কিং (৫৯) দম্পতি।
ভ্যাঙ্কুভারের ‘ফ্রীডম কৌভ’ বা ‘স্বাধীন দ্বীপ’
১৯৯২ সাল থেকে তারা এই দ্বিপটির নির্মাণ কাজ শিরু করে। এটি অবশ্য ইট, কাঠ, রড, সিমেন্ট দিয়েই তৈরি করা হয়েছে।
এই দম্পতীর দুজনেই শিল্পী। তাদের নির্মিত এই দ্বীপটিরে রয়েছে ড্যান্স ফ্লোর, আর্ট গ্যালারি এবং গ্রিন হাউজ প্রযুক্ত ব্যবহার করে ফলফুল আর সবজী বাগান। আর নয়নাভিরাম প্রাকৃতিক পরিবেশের কথা কি আর বলব।



কোরবানি বলে কথা

আর কয়েকদিন পরেই কোরবানির ঈদ বা ইদ। সেই উপলক্ষে সবাই নিজ দায়িত্তে রাস্তাঘাট, বাজার-মাঠ সর্বত্র ভিড় বাড়িয়ে চলেছে। এমনটা হওয়াই তো স্বাভাবিক। কোরবানির ঈদ বলে কথা। তবে এই ঈদে শপিংমলের চেয়ে গরু-ছাগলের হাটের দিকে মানুষের মনোযোগ থাকে বেশি। যার ফলে এই ঈদে গরু-ছাগল থেকে যোজন যোজন দূরে থাকা মানুষগুলোও হয়ে ওঠে পশু বিশেষজ্ঞ।

যাই হোক কোরবানি নিয়ে যেহেতু কচকচানি শুরু হয়েই গেছে তো একটা গল্প বলি – এক লোকের ছিল একটি ছাগল আর একটি গাধা। ছাগলটার সারাদিনের কাজ ছিল খাওয়া আর আরাম করা অন্যদিকে গাধাটা সারাদিন ধরে বোঝা টানত তার উপরে একটু গড়বর হলে মালিকের মার তো আছেই। তো ছাগলটা একদিন গাধাটাকে ডেকে বলছে – তোকে দেখে আমার বড্ড মায়া হয়, বুঝলি?
কেন? – গাধার প্রশ্ন।
না মানে, তুই সারাদিন এতো পরিশ্রম করিস তার উপরে মার খাস আর আমি সারাদিন কত আরামে থাকি, কোন কাজ নেই শুধু খেয়ে খেয়ে মোটা হচ্ছি।
‘তোকে তো যত্ন করবেই… সামনে তো কোরবানির ঈদ।’

আরেকটা গল্প বলি। আমার এক ফেবু বন্ধু (নাম মনে নাই) এটা লিখেছে তার ওয়ালে। বাবা-ছেলের কথোপকথন –
ছেলে – বাবা কোরবানির গরু কিনবেন না?
বাবা – হ্যাঁ, তাতো কিনতেই হবে; গাধা তো আর কোরবানি দেওয়া যায় না।

দিন শেষে একা

লাল রংটা কল্যাণের বেজায় অপছন্দ। কিন্তু আজ এই রঙটাই ওকে দেখতে হবে অনেকক্ষণ। তারপর…

হাতের ঘড়িটা একবার দেখেনিল কল্যাণ। তিনটা বেজে ছাব্বিশ। অনেক রাত। কিন্তু মোড়ের সিগারেটের দোকানটা এখনো খোলা। সারারাতই খোলা থাকে। খুব ইচ্ছে হচ্ছে গিয়ে একটা সিগারেট খেতে কিন্তু উপায় নেই, বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে। এঘড়ে কোন ছাতা নেই। এত রাতে মায়ের রুমে গিয়ে ছাতা নিয়ে আসার প্রশ্নই আসে না। অগত্তা সিগারেটের চিন্তাটা বাদ দিতে হল।
চিত হয়ে বিছানায় শুয়ে আছে ও। ভাবছে – এখনই শুরু করবে কি না। ভাবতে ভাবতে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল বুক চিড়ে। কত রঙিন মনে হত একসময় জীবনটাকে। মনে হত যত সমস্যা সব বড় হলেই ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু না বড় হওয়ার সাথে পাল্লা দিয়ে সমস্যাগুলোও আরও বড় হয়েছে। ও কাওকে বুঝতে দেয়না, দীর্ঘশ্বাসগুলো চাপা দিয়ে দেয় বুকের মধ্যে। মাঝে মাঝেই নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসতে চায় কিন্তু কাওকে বলে না।
একটা সময় খুব একাকীত্বে ভুগতো ও। খুব একা একা লাগত; খুব। তারপর নিজেই একসময় আবিষ্কার করল – একাকীত্ব আসলে দুর্বলতা নয় শক্তি, a source of energy. কারন? কারনটা খুব সহজ। একা মানুষের হারানোর ভয় থাকে না। এমন নয় যে ওর পৃথিবীতে কেউ নেই। আছে সবাই আছে – বাবা, মা, ভাই, বোন, আত্মীয় সবাই। কিন্তু এত মানুষের মাঝেও ও একা, বড় একা। মা ভাত বেড়ে খাওয়ায়, বাবা ভালোমন্দ জিজ্ঞেস করে, বোনের আদুরে শাসন, ভাইয়ের বায়না সবই ভালো লাগে তবুও কোথাও যেন একটা শূন্যতা, একটা ফাঁকা রয়ে গেছে যার ফলে জীবনটাকে বড় অর্থহীন লাগে। একবার ভেবেছিল বিয়ে করে ফেলবে অথবা একটা প্রেম। কিন্তু পরে ভেবে দেখল এতে ঝামেলা আরও বাড়বে। এতে পরিবারের সদস্য সংখ্যা একজন বাড়া ছাড়া আর তেমন কোন লাভ হবে না। বরং একাকীত্বের এই যে উপভোগটুকু, এটাও আর থাকবে না। একাকীত্বই হয়তো ওর নিয়তি।
যাইহোক ওসব চিন্তা বাদ। এখন শুধুই মুক্তির চিন্তা। মুক্তি কেন? কারন এই একাকীত্বও আর ও উপভোগ করতে পারবে না খুব বেশি দিন, এটাও ওর কাছে খুব বোরিং লাগতে শুরু করেছে। ও বুঝে গেছে – একাকীত্বের দীর্ঘ উপভোগ বলে কিছু হয় না।

শুয়ে থেকেই একবার বালিশ থেকে মাথাটা তুলে দেখে নিল টেবিলের উপর ব্লেড টা আছে কি না। আছে।

সকাল সাড়ে আট টা
‘কল্যাণ, এই কল্যাণ ওঠ অফিস যাবি না?’ মা দরজায় ধাক্কা দিচ্ছেন আর ডাকছেন।
আর একটু পর
কল্যাণের দরজায় বাড়ির সবাই এসে জড়ো হয়েছে। উদ্বিগ্ন প্রতিটা মুখ। মা কাঁদছেন। দরজার নিচে দিয়ে রক্ত বেরিয়ে আসতে দেখা যাচ্ছে, লাল রক্ত, লাল…

অসুখ

একগাদা ওষুধ লিখেছে ডাক্তার। সেগুলো নিতেই আজ এদিকটাতে আসা। নয়তো এদিকের এই ভিড়ের মধ্যে কে আসতে চায়। শহরের এদিকটায় আসার একটা ভালো দিকও আছে – এখানে প্রায় সব ওষুধ পাওয়া যায় তাও আবার পাইকারি দামে।
ছোট দোকানটায় যায়গা বড়ই কম তবুও মানুষের উপচে পড়া ভিড়। পনের মিনিট হতে চলল দাঁড়িয়ে আছি তো আছিই। সিরিয়াল পাবার নাম গন্ধও নেই।

অবশেষে কাউন্টারে গিয়ে দাঁড়ালাম। প্রেসক্রিপশনটা দোকানদারের হাতে দিলাম, ব্যস। এবার শুধু অপেক্ষার পালা। আমার বাঁদিকটায় দেয়াল, দোকানের শেষপ্রান্ত আর ডানপাশে দাঁড়িয়ে আছে এক বৃদ্ধ। তার ওষুধ নেওয়া বোধয় শেষ তবুও একবার মিলিয়ে দেখছে ঠিকঠাক আছে কি না। আমি সারি সারি করে সাজানো ওষুধের বাক্স দেখে দেখে নাম পড়ছি আর ভাবছি – সকল রোগের ওষুধ কি সত্যই পাওয়া যায়।
হঠাৎ সিনিয়র একজন দোকানদার জুনিয়র একজনকে প্রশ্ন করল -‘ওই চাচা কি ট্যাকা দিছিল’? আমি ডানে তাকিয়ে দেখলাম বুড়ো নেই।
‘না তো ভাই’। জুনিয়র উত্তর দিল।
‘ট্যাকা না দিয়া গেল কই? জলদী যা, খুইজ্জা লইয়ায়।’

কিছুক্ষণ পর ছেলেটা সেই বৃদ্ধ লোকটিকে হাতে ধরে নিয়ে এলো। স্বাভাবিক ভাবেও নয় আবার ঠিক টানতে টানতেও নয়। তবে দেখে বুঝা যাচ্ছে বুড়ো অনুসুচনায় ভুগছে।
‘চাচা আপনে ট্যাকা দিছিলেন ওষুধের?’ সিনিয়রের সরাসরি প্রশ্ন।
‘মানে…ইয়ে…’ বুড়ো আমতা আমতা করতে লাগল। ‘আসলে ভুল করে নিয়ে চলে গেছিলাম। এই নিন…’ বলে ওষুধগুলো কাউন্টারে রাখলেন। হঠাৎ বুড়োর চোখ জোড়া যেন ছলছল করে উঠলো।
‘ওষুধ চাই নাই তো, ট্যাকা দেন ওষুধ নেন।’
বুড়ো চুপ।
‘চাচা সমস্যাডা কি কনতো।’
আমরা আশেপাশের সবাই কৌতূহলী চোখে তাকিয়ে আছি বুড়োর দিকে। বুড়ো একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল, বলল – ‘আমার নাতিটা তিন দিন ধরে হাসপাতালে ভর্তি, আমার কাছে ওষুধ কেনার টাকা নাই’।

[সত্যা ঘটনা অবলম্বনে]

ছুটিবিহীন জীবন

এক ভদ্রলোক তার স্ট্যাটাসে লিখেছে, অনেকদিন ছুটি নেয় না, প্রায় দু’বছর। বন্ধুদের সাথে আড্ডা দেয় না, আত্মীয়দের বাসায় যায় না। শুধু অফিস টু বাসা, বাসা টু অফিস। আর এটা নাকি তার স্ত্রীর উৎসাহেই হয়েছে। লেখাটা পরে মনে হল না তিনি এই ব্যপারটায় অখুশি। তবে এখানে আমার একটা দ্বিমত আছে।

তোরাহ’তে আছে মসী (মুসা আঃ) যখন দেখলেন যে হিব্রু দাশ জাতির জীবনে ছুটি বলতে কিছু নেই তখন তিনি শনিবার কে হিব্রুদের ছুটি হিসেবে ঘোষণা করেন। দিনটিকে হিব্রুতে সাব্বাত বলা হয়। সহজ করে বলা যায় ‘মসীর দিন’। এটিকেই বলা চলে অফিসিয়ালি ছুটির প্রথম ঘোষণা। যাইহোক, মসী বুঝতে পেরেছিলেন যে সপ্তাহে এক দিন ছুটি না পেলে জীবনের সাভাবিক ছন্দ বা গতি কোনটাই থাকে না।

একই কারনে আমিও ছুটি না নেওয়াটাকে অপছন্দ করি। অবশ্য কিছু প্রতিষ্ঠান মালিকের কাছে ছুটি না নেওয়াটা একটা আইকনিক ব্যপার রীতিমত। সম্ভবত এক-দু’বছর আগে এক প্রাইমারী স্কুলের শিক্ষক পুরষ্কার পান এই কারনে যে তিনি তার সার্ভিস লাইফে একদিনও ছুটি নেননি। আমার হিসেবে লোকটিকে পুরষ্কার না দিয়ে তিরস্কার করা উচিৎ ছিল। কারন তিনি রীতিমত অসামাজিক একজন লোক। ‘ছুটি নেননি’ এই ব্যপারটা থেকে এটা পরিষ্কার যে তিনি নানান ধরণের দাওয়াত এমনকি শেষকৃত্তের অনুষ্ঠানেও ঠিকমত যোগ দেননি। কারন কোন অনুষ্ঠানে যোগ দিতে গেলে, পুরো অনুষ্ঠানে ঠিকমত অংশ নিয়ে শেষ করলে এক দিন তো নিশ্চিত ভাবেই লাগবে। কিন্তু তিনি তা নেননি। তাই তাকে সহজ ভাষায় অসামাজিক বলাই যায়।

সেই শিক্ষক লোকটির উদাহরণ দিয়েছিলেন একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের মালিক। উনার এহেন অসামাজিকতা ভালো লাগার কারন আছে বৈকি!

বৃহস্পতিবার, ৩ আগস্ট, ২০১৭

জীবনের মূল্য

মানুষের জীবনে ঘুম এক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ যায়গা জুড়ে রয়েছে। ডাক্তাররা বলেন অন্তত আট ঘণ্টা ঘুমানো উচিৎ। মানে দিনের তিন ভাগের এক ভাগ। অর্থাৎ এই নিয়ম অনুসরণ করলে আপনি জীবনের একতৃতীয়াংশই ঘুমিয়েই কাটিয়ে দিবেন। কোন মানে হয়? আমার অন্তত এই নিয়ম একেবারেই অপছন্দ। যদিও সাহিত্যিক শিবরাম চক্রবর্তী ব্যাপারটাকে দেখেছিলেন অন্য ভাবে। একবার এক পত্রিকার সাংবাদিক তার সাক্ষাৎকার নেওয়ার সময় জিজ্ঞেস করল – আপনি সাধারনত কখন ঘুমাতে যান? উত্তরে শিবরাম বাবু বললেন – যখন ঘুম পায়। আর কখন ঘুম থেকে ওঠেন? শিবরাম বাবু বললেন – যখন ঘুম ভাঙে।

ঘুমের কথা বলতে বলতে একটা কৌতুক মনে পড়ে গেলো। এক শিক্ষক ছাত্রকে জিজ্ঞেস করলেন – ঘুম পেলে আমারা বিছানায় যাই কেন? ছাত্র উত্তর দিল – বিছানা আমাদের কাছে আসে না তাই।

কম ঘুমিয়ে শরীর খারাপ করার পক্ষপাতী আমি নোই। তবে জীবন অমূল্য। শুধু ঘুমিয়ে এর একটা বড় অংশ শেষ করে দিতে আমার বড় আফসোস হয়। জীবনের মূল্য নিয়ে একটা ঘটনা বলি শুনুন – প্রায় পাঁচশ বছর আগেকার কথা। বর্তমান পাকিস্তানে পাঞ্জাব নামের যে প্রদেশটি রয়েছে সেখানে থাকতেন গুরু নানাক শাহ্‌। যিনি শিখ ধর্ম প্রবর্তন করেন। তার কাছে এক লোক গিয়ে বলল – বাবাজী জীবনের মূল্য কি আমাকে বোঝান? বাবাজী কোন উত্তর দিলেন না তবে লোকটিকে একটি চকচকে পাথর দিয়ে বললেন – বাজারে যাও, এই পাথরের কত দাম হয় জেনে আস কিন্তু বিক্রি করো না। লোকটি চলে গেল বাজারে।

বাজারে ঢুকেই সে দেখতে পেল এক লোক আলু বিক্রি করছে। সে তার কাছে গেল। বলল – ভাই এই পাথরটার কত দাম হবে তুমি বলতে পার? দোকানদার পাথরটা ভালো মত দেখে বলল – হুম, বেশ চকচকে। এটা আমাকে দিয়ে যাও বিনিময়ে এক সের আলু নিয়ে যাও। লোকটি বলল – না ভাই বাবাজী বলেছে শুধু দাম জানতে, বিক্রি করা যাবে না।

আলুর দেকান পেছনে রেখে কিছুদূর এগোতেই দেখা মিলল এক ফলের দোকানের। সেই দোকানের মালিককে পাথরটি দেখাতে সে বলল – এই পাথরের বিনিময়ে আমি তোমাকে ভালো কিছু ফল দিতে পারি। লোকটি রাজি হলো না কারন বিক্রির অনুমতি নেই।

এরপর তার দেখা হলো এক স্বর্ণকারের সাথে। সে লোকটিকে বলল – বাঃ এতো বেশ দামি পাথর এটা তুমি আমায় দিলে আমি তোমাকে হাজার মুদ্রা দিতে পারি। লোকটি তাকেও না দিয়ে আরও সামনে এগিয়ে গেল।

এবার দেখা মিলল এক জহুরীর। পাথরটি দেখে সে বিস্মিত হয়ে লোকটির দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকল। তারপর বলল – এই পাথর তুমি কথায় পেলে? লোকটি বলল – আমি যেখানেই পাই, এক কত দাম হবে তাই বলুন। আরে পাগল, এর দাম আমি কেন কোন জহুরীর পক্ষেই দেওয়া সম্ভব না; এটা অমুল্য – জহুরী বলল। এই শুনে লোকটি ছুটতে লাগলো নানাকজীর বাড়ির উদ্দেশ্যে।

ছুটতে ছুটতে লোকটি গুরু নানাকের কাছে এসে বলল – বাবাজী কি এই পাথর? কেন এর এত বৈচিত্র্যময় মূল্য? আমার জীবনের সাথে এর কিই বা সম্পর্ক?

গুরু নানাক মুচকি হেসে উত্তর দিলেন – মানুষের জীবনও এই পাথরের মত। সে চাইলে একে এক সের আলুর দামে বেচতে পারে অথবা কিছু ফলের দামে কিংবা হাজার মুদ্রায়। কিন্তু যদি সে চায় তবে জীবনকে অমূল্যও বানাতে পারে। ব্যক্তির জীবনের মূল্য নির্ভর করে তার দৃষ্টিভঙ্গির উপর।