বৃহস্পতিবার, ২৯ ডিসেম্বর, ২০১৬

আহা জীবন

আহা জীবন! কত স্বাদ বেঁচে থাকার। আমিও আছি একরকম।
আচ্ছা ও কি জানে আমি কখন কিভাবে বেঁচে থাকি? কতবার কিভাবে মরেছি? জানে না বোধয়। ও শুধু জানে আদর, যত্ন আর ভালবাসা। প্রেম, ব্যাপারটা কি ও ঠিকঠাক বোঝে? আমিই কি বুঝি?
গতপরশু খুব মন খারাপ ছিল আমার, ও বারবার জানতে চাইল কেন মন খারাপ? আমি বোঝাতেই পারলাম না যে কারণ আমার জানা নেই। শেষমেশ ওরও মন খারাপ হয়ে গেল। বুঝতেই পারল না আমার কেন যে মন খারাপ তা যদি আমি জানতাম তাহলে ওকে বলতাম। ওর চেয়ে ভালো আর কে বাসে আমাকে?
ওর বুকের মধ্যে মুখ গুজে দিলে একটা সুন্দর গন্ধ পাই। একটা স্বর্গীয় সুখ। আহা এই তো জীবন। এভাবেই বাঁচতে চাই।
প্রথম যেদিন ওর ঠোঁট আমার ঠোঁটকে ছুঁয়ে গেল মনে হোল যেন নিজেই নিজের ঠোঁট ছুঁয়ে দিলাম। ওটা যেন আমারি ঠোঁট। ও যদি আমার হয় তাহলে ওর ঠোঁট কেন আমার হবে না। সেই উষ্ণ কোমল ঠোঁট আমি শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত মনে রাখব।
সিগারেট খেয়ে ওর সামনে গেলে চোখের দিকে তাকাতে পারি না আমি। মায়াবী চোখ দুটি অবুঝ প্রশ্ন ছুড়ে দেয় আমার দিকে - কেন? কি যে অস্বস্তিতে পরে যাই আমি।
ওকে জড়িয়ে ধরে একটা জীবন কাটিয়ে দেওয়ার মত কাল্পনিক ভাবনা আমি ভাবি না, পাশাপাশি দাড়িয়ে লড়ে যেতে চাই একসাথে। বাঁচতে চাই একটা জীবন।
বিধি বাম। আদমের মত আমার কপালেও স্বর্গসুখ সইলো না। আজ ও চলে যাচ্ছে, আবার দেখা হবে কিনা জানি না।

বুধবার, ২৮ ডিসেম্বর, ২০১৬

সেলসম্যান

এদিক ওদিক তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করলাম কজনের চোখে পড়েছে ব্যাপারটা।
রিক্সাটার জন্যেই যত গণ্ডগোল। ভাবলাম রিক্সাটা আসতে আসতে আমি রাস্তা পার হয়ে যাব। বুঝতেই পারিনি ওটার পেছনেযে মোটর লাগানো আছে। এই এক যন্ত্রণা হয়েছে আজকাল, একে একে রিক্সাগুলোকে ধরে ধরে মোটর লাগিয়ে দেওয়া হচ্ছে। অনেকটা কচ্ছপের পেছনে মোটর লাগিয়ে দেওয়ার মত ব্যপার!
যখন বুঝলাম ওটা মোটর লাগানো রিক্সা গতি বেশি তখন দ্রুত পার হতে গিয়ে হুড়মুড় করে গিয়ে পরলাম একটা অটোর (ইজি বাইক) সামনে। মনে হয় পূর্বপুরুষের পুণ্য ছিল তাই অটোটা ব্রেক কষল। ধপাস করে সামনের গ্লাসে একটা ধাক্কা খেয়ে রাস্তায় পড়লাম।
কয়েক মুহূর্তের মৃত্যুভয় তারপর অটোওয়ালার বকা শুনতে শুনতে উঠে রাস্তা পার হলাম। গালিগালাজ করেনি সম্ভবত পরনের পোশাগুলোর জন্য। সভ্য দুনিয়ায় মানুষের ওজন বাড়ানো-কমানোর ক্ষেত্রে পোশাক একটা বড় ভূমিকা রাখে।
বেশি কিছু হয়নি, বাঁহাতের আস্তিনের দিকে কিছুটা ছিঁড়ে গেছে। চামড়াও ছড়ে গেছে কিছুটা। জ্বলছে। 


ছেঁড়া শার্ট নিয়ে ঘুরে বেড়ানোটা খুব বিরক্তিকর। চাইলে এখনি বাড়ি গিয়ে বদলে আসতে পারি কিন্তু তাতে অনেক দেরি হয়ে যাব। হাতাটা গুটিয়ে এভাবেই যেতে হবে।
স্কুলে এসব নিয়ে খুব বায়না করতাম। পোশাক পরিষ্কার আর ইস্ত্রি করা না হলে আমি পড়তাম না। এখন তো আর সেসব দিন নেই। টাকা যখন পায়ের শেকল হয়ে যায় তখন রুচিবোধ বদলাতে বাধ্য।
কোন একটা ডিসপেনসারি থেকে হাতটা একটু পরিষ্কার করিয়ে নেবো। ওষুধ লাগবে না, অযথা টাকার গচ্চা। দূর্বাঘাসের রস দেওয়া যেতে পারতো। কিন্তু এই শহরে দূর্বাঘাস পাওয়া যায় নির্দিষ্ট কয়েকটা যায়গায়। তার উপর ওগুলোতে ধুলোর প্রলেপ তো থাকবেই। ওসব ভেষজ চিন্তা বাদ দেওয়াই ভালো এটা ধুলোর যুগ।

দোকানদাররা এমনিই সেলসম্যানদেরকে খুব ভালো চোখে দেখে না, তার উপর আজ আবার ছেঁড়া শার্ট! খুব খেয়াল করেছি ভালো পোশাক, সুন্দর করে আঁচড়ানো চুল, ক্লিন শেভড মুখ, চকচকে জুতা, হাতে ভালো একটা ঘড়ি এসব থাকলে বেশি অর্ডার পাওয়া যায়। চাকরীর শুরুতে কিছুদিন বন্ধুদের কাছথেকে এসব ধার করে পরে দেখেছি। অবশ্য এটা ছাড়া আর কোন রাস্তাও ছিল না, চাকরীটা পাকা করার জন্য তখন এই কৌশলটা খুব দরকার ছিল।

পরপর কিছুদিন অর্ডার খারাপ হলে ছাঁটাই করে দিতে কোম্পানি দুবার ভাববে না। এসব চাকরীর কোন ভরসা নেই। এই অবস্থায় চাকরীটা গেলে রাস্তায় গিয়ে দাঁড়াতে হবে। ভাগ্যিস এক্সিডেন্টটা গুরুতর হয়নি, হলে হাসপাতালের খরচ কি করে দিতাম? ভাবতেই গাটা শিউড়ে উঠছে। মরে গেলে অবশ্য বেঁচে যেতাম।
সাধারণত অন্য কিছু করার সুযোগ না থাকলেই কেউ সেলসম্যান হিসেবে কাজ করে। আমিও ব্যতিক্রম নই। ছোটবেলায় স্বপ্ন দেখতাম ব্যাংকার হবো। তা তো আর হল না।তাই... জীবনের তাগিদে অল্প কিছু টাকার জন্যে আমি বেঁচে দিলাম আমার স্বপ্ন, রুচিবোধ আর ব্যাক্তিত্ব।

শনিবার, ১৭ ডিসেম্বর, ২০১৬

জন্মাষ্টমী ~ প্রসেঞ্জিত বোস

আজ রাত্রেই মেয়েটি জন্মায়। গোকুলে ও গোপনে। তার মা তখন প্রসব-পীড়ায় অচেতন। কিছুক্ষণ পর যমুনার ওপার থেকে একটি লোক আসে। নিজের সদ্যোজাত ছেলেটিকে গচ্ছিত রেখে চুপিচুপি মেয়েটিকে তুলে নেয়। মায়ের মুখটি ভাল করে দেখার আগেই জন্মের মতো পরিবার-হারা হয় সেই মেয়ে।

মেয়েটিকে পাচার করা হয় মথুরার এক ঘুপচি কারাগারে। ছেলেটির প্রাণ মূল্যবান। তার প্রক্সি হিসেবে মেয়েটিকে রেখে দেওয়া হয়। মথুরার রাজা ছেলেটিকে মারতে এসে মেয়েটিকে পায় ও তাকেই নিয়ে যায়। মেয়েটি দ্বিতীয় বার হাতবদল হয়।

রাজা যখন পাথরের দেওয়ালে আছাড় মারতে যাচ্ছে কয়েক-ঘণ্টা-আগে-জন্মানো পুঁচকে মেয়েটিকে, হাত পিছলে ছিটকে যায় সে। তারপর কোনও এক অজানা ঘটনা-পরম্পরায় তার ঠাঁই হয় দুর্গম বিন্ধ্য পর্বতে। সেখানেই সে বড় হয়।

মেয়েটির মা-বাবার কাছে ছেলেটিও বড় হয়। একটা সময়ে সেই মা-বাবা সত্যিটা জানতে পারে। ছেলেটি মথুরায় আসল মা-বাবার কাছে ফেরৎ যায়। কিন্তু মেয়েটির মা-বাবা ভুলেও হারানো মেয়ের খোঁজ করে না। কী লাভ খুঁজে ? হারানো, চুরি-যাওয়া, বিক্রি-হয়ে-যাওয়া, পাচার-হয়ে-যাওয়া ছেলেদের ঘরে তোলা যায়। মেয়েদের যায় না।

ছেলেটির এখন দু-জোড়া মা-বাবা। তার জীবনে অনেক প্রেম আসে। অনেক স্ত্রী আসে। অনেক সন্তান আসে। আসে রাজত্ব।

মেয়েটির ? কেউ জানে না। তার এক-জোড়া মা-বাবা, একটি প্রেমিক, একটি স্বামী, একটি সন্তান, একটুও ভূমি জুটেছিল কিনা, কেউ খোঁজ রাখেনি।

একটি ছেলে-বাচ্চাকে বাঁচাতে প্রক্সি হয়েছিল সে, এই তার একমাত্র পরিচয়।

শুভ জন্মাষ্টমী। শুধু কৃষ্ণের নয়, আজ যোগমায়ারও জন্মরাত।

শুক্রবার, ১৬ ডিসেম্বর, ২০১৬

মিশ্রণ - ৫

১) খুব ভালো চকলেট খেলে অনেকক্ষণ স্বাদটা মুখে লেগে থাকে, তেমনি খুব ভালো সিনেমা দেখলে অনেকক্ষণ স্বাদটা মনে লেগে থাকে। কিছুদিন আগে তেমনি একটা সিমেনা দেখার সুযোগ হোল। বাজিরাও মাস্তানি, আহা! কি চমৎকার কাজ, a work of art. যেমন দৃশ্যায়ন, তেমন সঙ্গীত, সেই অনুযায়ী অভিনয়। যদিও অভিনয়ের দিক থেকে আমি মাস্তানি অর্থাৎ দীপিকাকেই এগিয়ে রাখবো।মিঃ বনশালি তার কাজের মান অটুট রেখেছেন বলতে হবে। একটা কথা না বললেই না, প্রিয়াঙ্কা মুখ্য চরিত্রে না থাকলেও তার চরিত্রটার একটা আলাদা গুরুত্ব ছিল, সেই যায়গাতে প্রিয়াঙ্কা একশতে একশ, অভিজ্ঞতার একটা আলাদা মূল্য তো আছে।
ঘটনা বর্ণনা বা সমালোচনায় যাব না শুধু বলবো - আফসোস হয়েছে এতো দেরি করে দেখার জন্যে।
২) একটা ডকুমেন্টারি দেখলাম কিছুদিন আগে, সৌদি আরবের উপর। এর বিভিন্ন অংশ গোপনে ধারণ করা হয়েছে। বিভিন্ন বিষয় উঠে এসেছে এতে, বেশ কয়েকটি আগে জানলেও কিছু বিষয় জানতাম না। মোটকথা বলা যায় - অনেকেরই জীবন সেখানে দুর্বিষহ, কেউ মুক্তির অপেক্ষায়, কেউ মৃত্যুর!
৩) আমার সমস্যা হোল এক যায়গায় স্থির থাকতে পারি না। বই পড়ার সময়ও তাই। এই বই কিছুতা পরে রেখে দিয়ে অন্য একটা নিয়ে বসলাম, সেটা কিছুটা পরে তারপর আবার অন্য একটা তারপর হয়তো আবার প্রথমটায় ফেরত গেলাম! এভাবে কিছু বই গুলিয়ে-মিলিয়ে পড়া হয় আবার কিছু বই শেষকরা হয়ে ওঠে না।
আজকাল যেগুলো নিয়ে আছেঃ
# মন্টেজুমার মেয়ে (দ্বিতীয়বারের মতো পড়ছি)
# চাপড় ঘণ্ট (একটু বাকি আছে)
# পিন্‌ডিদার গপ্‌পো (কিছুটা পড়েছি)
# রবীন্দ্রনাথ এখানে কখনও খেতে আসেন নি (একটু বাকি আছে)
# ঋভু (কিছুটা পড়েছি)
# রাধাকৃষ্ণ (পড়ছি, শেষ করবোই)

বুধবার, ৭ ডিসেম্বর, ২০১৬

রাবণের গুণ

রামায়ণ মহাকাব্যে রামের মেলা গুণ – রাজপুরুষত্বম, ধর্মপরায়ণ, বীর, ধীর, সুসভ্য, সুকান্ত, জ্ঞানী, গুণী ইত্যাদি আর রাবণ তার উল্টো বিকলাঙ্গ (দশমুণ্ড), স্বৈরাচারী, অসভ্য, রাক্ষস, কামুক ইত্যাদি। কিন্তু এমন প্রশ্ন মনে আসতেই পারে যে, রামায়ণের রচয়েতা বাল্মীকি (বা যেই হোক) এর আর্যপ্রীতি ও অনার্যবিদ্বেষের কারনেই কি রামকে নায়ক আর রাবণকে ভিলেন হিসেবে দেখান হয়েছে? কারন ঘটনা বর্ণনার নানা ফাঁকফোকর দিয়ে রাবণের কৌলিন্য, শৌর্য-বীর্য ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রকাশ দেখতে পাওয়া যায়; যার ঔজ্জ্বল্য রামের উজ্জ্বলতার চেয়ে বহুগুণ বেশী।

রাম ছিলেন ক্ষত্রিয়, চার বর্ণের দ্বিতীয় বর্ণের মানুষ। সেকালের ক্ষত্রিয়রা ছিলো বংশগত যোদ্ধা, অর্থাৎ নরঘাতক। অন্যদিকে রাবণের দাদা পুলস্ত্য ছিলেন ব্ৰহ্মার মানসপুত্র এবং স্বনামধন্য ঋষি, পিতা বিশ্ৰবাও ছিলেন একজন বিশিষ্ট ঋষি। ঋষি মাত্রেই ব্রাহ্মণ। ব্রাহ্মণ-এর সাধারণ সংজ্ঞা হলো – ব্রহ্মাংশে জন্ম যার, অথবা বেদ জানে যে, কিংবা বেদ অধ্যয়ন করে যে, নতুবা ব্রহ্মের উপাসনা করে যে। রাবণ গুণগত না হলেও কুলগত ব্ৰাহ্মণ ছিলেন নিশ্চয়ই।

রাবণের রাজমহলকে (কখনো লঙ্কাকেও) বলা হয়েছে ‘স্বর্ণপুরী, তার প্রমোদ উদ্যান অশোক কাননে ছিল বহু বৃক্ষের সমাহার। এতে রাবণের ঐশ্বর্য, শিল্প-নিপুণতা, সৌন্দর্যপ্রিয়তা, রুচিবোধ, বৃক্ষপ্রেম ইত্যাদি বহু গুণের পরিচয় মেলে। কিন্তু রামের ক্ষেত্রে এমন কিছুর উল্লেখ দেখা যায় না।

রাম লঙ্কায় পৌঁছতে বহু লোকের সাহায্য নিয়ে – দীর্ঘ সময় নিয়ে সেতু নির্মাণ করেছিল আর রাবণ প্রযুক্তিতে এতই উন্নত ছিল যে, পুষ্পক নামের রথ ব্যবহার করে অল্প সময়েই পৌঁছে গিয়েছিল। রাম যুদ্ধ করেছে তীর-ধনুক নিয়ে আর রাবণ ব্যবহার করেছেন শক্তিশেল।

ব্রাহ্মন বংশীয় রাবণকে নরখাদক বলা হলেও তার কোন প্রমান মেলেনি অপরদিকে রামের আঘাতে মৃত্যু পথযাত্রী হয়েও রামকে রাজনৈতিক উপদেশ দিয়ে রাবণ উদারতার পরিচয়ই দিয়ে গেছে।

রামের সংসারজীবনে ৫২ বছরে কোন সন্তানাদি হয়নি যদিও সীতা বন্ধা ছিলো না, তার প্রমাণ – কুশ ও লব। এদিক থেকে রামকে ফিজিক্যালি আনফিট বলা যেতে পারে।

রাম তার জন্য সর্বস্ব ত্যাগ করা সীতাকে ত্যাগ করেছিল প্রজাদের খুশি করার জন্য তাও আবার দুই যুগেরও বেশি সময় পরে। অপরদিকে অদেবতা অষ্টম এডওয়ার্ড এর কথাই ধরুন, প্রেমিকার জন্য সিংহাসন ছেড়ে দিয়েছিলেন।

রাবণকে বলা হয়েছে দশানন (দশ মাথাওয়ালা), সম্ভবত সে দশ জনের সমান বুদ্ধি রাখত বলেই (বাস্তবে দশ মাথাওয়ালা নয়)। আর রাম…

* * * * * * * * * *
কৃতজ্ঞতাঃ আরজ আলী মাতুব্বর