বৃহস্পতিবার, ২৮ মে, ২০২০

কে

বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে। ঝুম বৃষ্টি না। তারচেয়ে একটু কম। মাঝারি বর্ষণ বলা যেতে পারে। বিছানায় শুয়ে বৃষ্টির শব্দ শুনছি। একবার মনে হোলো জানালাটা খুলে বৃষ্টি দেখি কিন্তু পর মুহূর্তেই চিন্তাটা বাদ দিয়ে দিলাম। কারণ জানালা খুললেই ঘরে মশা ঢুকবে। আর মশা ঢুকলেই কয়েল ধরাতে হবে। এখন কয়েল ধরাতে ইচ্ছে করছে না। তাই চুপচাপ শুয়েই থাকলাম।

আমার পরিবার বলতে আমি আর আম্মা। এখন আম্মা নেই। খালার বাড়িতে গেছেন। ফিরতে সন্ধ্যে হবে।
হঠাৎ দরজায় টোকা দেওয়ার শব্দ হলো। অবাক হয়ে ভাবলাম - আম্মা এত তাড়াতাড়ি এসেগেছেন! এক ঘণ্টাও তো হয়নি। খালার বাড়িতে যেতে আসতেই তো এক ঘণ্টার বেশি লাগার কথা। নাকি যায়নি কোন কারনে। এসব ভাবতে ভাবতে আবার দরজায় টোকা পড়ল।

বিছানা ছেড়ে দরজার কাছে গেলাম। দরজাটা খুলতে যাব এমন সময় বাইরে থেকে হাঁক দিয়ে উঠল - আম্মা দরজা খোলো, এতক্ষণ লাগে...

চমকে উঠলাম। আরে এটা তো আমার গলা!

রম্য লেখার চেষ্টা

রম্য লেখার সিরাম চেষ্টা করেও যখন কিছু হয় না। তখন নিজেকে চিপে ভেতর থেকে রস বের করা ছাড়া তো আর কিছু করার থাকে না। নিচের লেখাগুলো তারই প্রকাশ। সাম্প্রতিক সময়ে এগুলো আমার ফেসবুকে স্থান পেয়েছে আর লাইক-কমেন্টের অভাবে ফেসবুক ফেটে চৌচির হওয়ার যোগাড় হয়েছে!

(১)
সালমান খানরে একবার প্রশ্ন করা হয় - রাতে যখন ঘুম আসে না, বিছানায় শুয়ে এপাশ ওপাশ করেন তখন তিনি কি চিন্তা করেন।
তিনি উত্তরে বলেন যে তার নাকি বিছানায় ঘুম আসে না তাই কাউচের উপড়ে ঘুমান।

আমারও রাতে ঘুম আসে না কিন্তু ডাক্তারের নির্দেশ ৮ ঘণ্টা ঘুমাতে হবে। তাই ভালাম সালমান খান টেকনিকটা আপ্লাই করে দেখি। কিন্তু কাউচ কোই পাবো। আমার ছাপরায় তো কাউচ নাই। তাই একটা বুদ্ধি বাইর করলাম। তিনটা চেয়ার এক যায়গায় কইরা তার উপড়ে তোষকটা চাপায়া সাইডে দুইটা বালিশ দিয়া একখান ফলস কাউচ বানাইলাম।

শুয়া দেখি দারুণ ফিলিংস। পাঁচ মিনিটের মধ্যেই ঘুম আইসা পড়ল😴 স্বপ্ন দেখলাম - আমি সালমান খানের বাড়িতে কাউচের উপড়ে ঘুমায়া আছি এমন সময় সালমান খান আইসা উপস্থিত। সে আমার দিকে একটা পিস্তল তাক কইরা বলল - তোর সইল্লে এত্তুডি ছ্যাদা করুম যে কনফিউজড হয়া যাবি, শ্বাস কোন দিক দিয়া নিবি আর...

ধড়ফড় কইরা ঘুম থাইকা উঠতে গিয়া তাল সামলাইতে পারলাম না চেয়ারগুলি নিয়া পইড়া গেলাম। শব্দ শুইনা আম্মা পাশের ঘড় থাইকা দৌড়াইয়া আইসা দেখে ফ্লোরের উপড়ে তিনটা চেয়ার, একটা তোষক, দুইটা বালিশের সাথে আমিও পইড়া আছি😝

কি বলবো বুঝলাম না। দাঁত ক্যালাইনা একটা হাসি দিলাম😁 ওইটারে হাসি না বইলা দাঁত দেখান বললেই ভালো হয়। বাংলা সিনেমার হিরোদের সৃতিশক্তি হারাইলে হিরোর মায়েরা হিরোদের দিকে যেইভাবে তাকায় আম্মা আমার দিকে সেইভাবে তাকাইল।


(২)
সকাল থাইকাই প্রতিজ্ঞা করি ১২ টার মধ্যে ঘুমায়া পড়ব। কিন্তু সন্ধ্যার পর থাইকা কেমন জানি সব আউলায়া যায়। ইউটিউব-ফেসবুকে সব ফাটাফাটি জিনিস আবিষ্কার করি। মাথায় দারুণ-দারুণ সব আইডিয়া আসে, মনে হয় আইজ রাইতেই গীতাঞ্জলির মত কিছু একটা লেইখা ফেলব🤔

একটু ইউটিউব, একটু ফেসবুক, একটু বই পরা, একটু সিনেমা দেখা আরও হাবিজাবি কামকাজ করতে করতে বাইজা যায় ১২ টা। এরপর লাগে খিদা। হালকা-পাতলা কিছু খাই। তারপর মনে হয় আরে ডাক্তারতো বলেছেন খাওয়ার অন্তত এক ঘণ্টা পরে ঘুমাইতে। ব্যাস...আগামী এক ঘণ্টার জন্যে আমার জাইগা থাকা জায়েজ😁

রাইত একটার দিকে আবার খিদালাগে...😜


(৩)
ছোট সময় আমি ভাবতাম - আমার ডাক্তার হওয়া ঠেকায় কে! এই রকম ভাবার কারণ আমার হাতের লেখা ছিল খুবই খারাপ।

একাধিক শিক্ষক আর হাপ ডজন বড় ভাইবোন আমাকে পড়াইতে ব্যর্থ হওয়ার পর আব্বা আমাকে পড়ানোর দায়িত্ত নিলেন। আব্বা খুবই রাগী লোক। এমনিতেই হাতের লেখা খারাপ তার উপরে আব্বা যখন কিছু লিখতে দিতেন তখন ভয়ে হাতে কাপাকাপি শুরু হইয়া যাইত। আব্বা ব্যাপারটা বুঝতে পারতেন। তাই হাতের লেখা নিয়া কোনদিন মারেন নাই শুধু একদিন বললেন - মাঝে মধ্যে বাংলা ভাষাতেও লেইখো তোমার ফার্সি তো আমার বুঝে আসে না।

আব্বা যেইদিন রাগ করতেন সেইদিন এলোপাথাড়ি মাইর দিতেন। আমার চিৎকার আর আব্বার এক্সপ্রেশনে এলাকাবাসী ভাবতো আশেপাশে কোন যায়গায় চোর ধরা পড়েছে। তাকে উত্তমমধ্যম দেওয়া হচ্ছে।

শুরুটা যেহেতু ডাক্তার দিয়ে করেছি তাই শেষটাও ডাক্তার দিয়েই করি...

'বানপ্রস্থের পথে' বইতে ওবায়দুল হক লিখেছেন- 'আপনার যদি অসুখ হয়, ডাক্তারকে কল করবেন। কারণ ওকে খেয়ে-পরে বাঁচতে হবে। ডাক্তার যে প্রেসক্রিপশন দেবে সে অনুযায়ী ওষুধ কিনবেন। কারণ ওষুধ দোকানিকে খেয়ে-পরে বেঁচে থাকতে হবে। যে ওষুধ কিনে আনবেন খবরদার তা খাবেন না। কারণ আপনাকেও বেঁচে থাকতে হবে।'

শনিবার, ২৩ মে, ২০২০

স্বপ্ন

এক
তখনো এদেশে লকডাউন শুরু হয়নি। রাতে খেয়েদেয়ে সাড়ে নয়টার মধ্যে বাসা থেকে বেড়িয়ে পড়লাম। গন্তব্য - রেজা ভাইয়ের বাসা। গিয়ে দেখি ভদ্রলোক ছাদের উপর একটা পাটির উপর চিত হয়ে শুয়ে উদাস ভাবে সিগারেট টানছেন আর আকাশের দিকে ধোঁয়া ছাড়ছেন। আমার দিকে না তাকিয়েই বললেন - এসো লেখক। 
আমি গিয়ে তার পাশে বসলাম। জিজ্ঞেস করলাম - কি করে বুঝলেন যে আমি? তিনি এবারো আমার দিকে না তাকিয়ে উত্তর দিলেন - পায়ের শব্দ।

মনে মনে ভাবলাম লোকটা কত অদ্ভুত। একটা দোতলা বাড়ির ছাদের উপর পিচ্চি পিচ্চি দুটো ঘর ভাড়া নিয়ে থাকেন। গাদা গাদা বইপত্র, ম্যাগাজিন আর কাগজত্রে ঠাসা দুটো ঘর। একটা ল্যাপটপ আছে। আমি নিশ্চিত ওর মধ্যে বিনোদনমূলক কিছুই খুঁজে পাওয়া যাবে না। ছাদের উপর অন্তত ত্রিশ প্রজাতির ক্যাকটাস দিয়ে একটা বাগান করেছেন। মাঝে মধ্যে এসব ছেড়ে কিছুদিনের জন্য হাওয়া হয়ে যান। এই হাওয়া হয়ে যাওয়ার ব্যাপারটাই অবশ্য তাকে অন্যদের থেকে আলাদা করেছে। তিনি বাড়ি থেকে বেড়িয়ে পরেন গল্পের খোঁজে। সেসব গল্প কখনো হয় রহস্যময়, কখনো অদ্ভুত, কখনো ভয়ংকর আবার কখনো বা সুযোগ করে দেয় মাথা খাটানোর।

এই যে পৃথিবী জুড়ে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার কথা বলা হচ্ছে তুমি কি তা মানবে না বলে ঠিক করেছ? - রেজা ভাই আমার দিকে তাকিয়ে হাসি মুখে বললেন। আকাশে ভরা জোছনা থাকায় তার হাসিটা দেখতে পেলাম। 
কেন বলুন তো? - অবাক হয়ে জানতে চাইলাম।
তুমি কি আমার থেকে তিন ফুট দূরে আছ?
ও আচ্ছা সরে যাচ্ছি। - বলে উঠে পড়লাম। রেজা ভাইও উঠে পরলেন। বললেন - চল ঘর থেকে দুটো চেয়ার এনে বসি।

আমরা ঘর থেকে চেয়ার এনে বসলাম। জিজ্ঞেস করলাম - কি ভাবছিলেন শুয়ে শুয়ে?
একটা সিগারেট ধড়িয়ে বুক ভরে ধোঁয়া টেনে নিয়ে উপরের দিকে ছেড়ে রেজা ভাই বললেন - স্বপ্ন নিয়ে ভাবছিলাম। এরপর সিগারেটে আরও একটা টান দিয়ে ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে বললেন - স্বপ্ন জিনিসটা ভারি অদ্ভুত। হাজার হাজার বছর ধরে মানুষ এটা নিয়ে ভাবছে কিন্তু কোন সমাধানে আসতে পারছে না। জানো প্রাচীন মেসোপটেমিয়ার লোকেরা বিশ্বাস করত যে মানুষ ঘুমিয়ে পড়লে আত্মা শরীর থেকে বেড়িয়ে স্বপ্নরাজ্যে ঘুরে বেড়ায়। তাদের বিশ্বাস মতে তুমি আর আমি ঘুমের মধ্যে যেহেতু একই স্বপ্নরাজ্যে ঘুরে বেড়াই তাই তুমি আর আমি প্রায় একই স্বপ্ন দেখতে পারি এমনকি স্বপ্নে আমাদের দেখাও হয়ে যেতে পারে। স্বপ্ন নিয়ে তোমাকে একটা ইন্টারেস্টিং ঘটনা বলি শোন।

আমি চেয়ারের উপর একটু এগিয়ে এসে বসলাম। রেজা ভাই গল্প শুরু করলেন - ১৯৬৬ সাল। ইংল্যান্ডের দক্ষিণ ওয়েলসের পাহাড়ে ঘেরা একটি গ্রাম এ্যাবাফেন। সেই গ্রামের অনেকেরই পেশা ছিল খনি থেকে কয়লা উত্তোলন করা। গ্রামের শ্রমিকেরা খনি থেকে কয়লা তুলে গাড়িতে ভরে দিত তারপর সেই কয়লা চলে যেত শহরের উদ্দেশ্যে। আর কয়লার যে অবশিষ্টাংশগুলো পড়ে থাকতো সেগুলোকে ছোট ছোট স্তুপ করে রাখা হতো গ্রামের আশেপাশের পাহাড়গুলোতে।
সেবছরের অক্টোবরে প্রচুর বৃষ্টিপাত হয় দক্ষিণ ওয়েলসে। এতে গ্রামের পাহাড়গুলোর ছিদ্রযুক্ত বালিপাথর চুঁয়ে চুঁয়ে বৃষ্টির পানি ভূগর্ভে ঢুকতে থাকে। এ পানি পাহাড়ের গর্ভে থাকা সুপ্ত ঝর্ণাগুলোর সঙ্গে মিশে প্রবাহ তৈরি করে। এই প্রবাহের ধাক্কায় ধিরে ধিরে কয়লার স্তূপগুলো ক্ষয়ে যেতে শুরু করে। ২১ অক্টোবর সকাল নাগাদ পানির এই প্রবাহ অনেক বেশি শক্তিশালী হয়ে ওঠে। নয়টার দিকে একে একে কয়লার স্তূপগুলো আছড়ে পড়তে থাকে গ্রামের দিকে। চতুর্মুখী পাহাড় ধ্বসের স্বীকার হয় গ্রামটি। যেই কয়লা এতদিন তাদের বাঁচিয়ে রেখেছিল এখন সেই কয়লাই তাদের যমদূত হয়ে উঠল। গ্রামের অনেক লোক মারা যায় সেদিন। সব থেকে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় গ্রামের স্কুলটি। স্কুলে থাকা ১৩৯ টি শিশু আর পাঁচ জন শিক্ষক সেদিন মারা যান।
সে সময়ের একজন ইংরেজ প্যারা সাইকোলজিস্ট জন বারকার যিনি কিনা স্বপ্নে ভবিষ্যৎবানী পাওয়া নিয়ে গবেষণা করছিলেন পত্রিকায় একটি বিজ্ঞপ্তি দেন এটা জানতে চেয়ে যে এ্যাবাফেন গ্রামের দুর্যোগটি ঘটার আগে কেউ কোন ইঙ্গিত পেয়েছিলেন কিনা তা সে স্বপ্নে হোক বা অন্য কোনো ভাবে।
এই বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের পর তিনি ষাটটি চিঠি পেয়েছিলেন যার অধিকাংশের মধ্যেই একটি দাবী করা হয়েছিল যে - তারা স্বপ্নে এই দুর্যোগটি সম্পর্কে আগেই জেনেছিলেন। এই দাবীদারদের মধ্যে এ্যাবাফেন গ্রামের স্কুলে মারা যাওয়া একটি শিশুর মা-বাবাও ছিলেন। তারা বলেন তাদের ছেলেটি সেদিন স্কুলে যেতে চাচ্ছিল না। সে বলেছিল, রাতে সে স্বপ্নে দেখেছে যে কালো কিছু একটা তাদের স্কুলকে ঘিরে ফেলেছে।

মানুষ কি সত্যিই স্বপ্নে ভবিষ্যৎ দেখতে পায়? আমি অবাক হয়ে জানতে চাইলাম।
কিছু কিছু মানুষ পায় বলে গবেষকরা মনে করেন। এধরনের স্বপ্নকে বলে প্রিকগনেটিভ ড্রিমস। শেষ হয়ে যাওয়া সিগারেটটা নিচে ফেলে পা দিয়ে নিভিয়ে দিতে দিতে বললেন রেজা ভাই। তুমি কি জান যে জন্মান্ধ লোকেরাও স্বপ্ন দেখতে পায়?
জিনা জানি না। - আমি বললাম।
অন্ধরা স্বপ্ন দেখতে পারে কথাটা অবশ্য ভুল। বলা উচিৎ ছিল অন্ধরা স্বপ্ন অনুভব করতে পারে। কারণ তাদের স্বপ্নে কোন ছবি থাকে না। তাদের স্বপ্নও আমাদের মত প্রাণবন্ত হয়। এই পর্যন্ত বলে রেজা ভাই থামলেন। একটা সিগারেট ধড়িয়ে ফের বলতে শুরু করলেন - আমার এক অন্ধ লোকের সাথে দেখা হয়েছিল ঈশ্বরগঞ্জে। অদ্ভুত ভয়ংকর সব স্বপ্ন দেখত লোকটা। তুমি কি তার গল্পটা শুনতে চাও?
জি শুনতে চাই। 


দুই
আমার কলেজের বন্ধু সাদিক বহুদিন থেকেই বলছিল ওদের বাড়িতে যাওয়ার জন্য। আমি একাধিক বার আসবো বললেও শেষপর্যন্ত যাওয়া হয়নি। সেবার আমায় ফোন করে বলল, এক অদ্ভুত লোকের দেখা পেয়েছে সে, গেলে দেখা করিয়ে দিবে। বর্ণনা শুনে বেশ অদ্ভুত লাগলো তাই পরদিন সকাল সকাল উঠে রওয়ানা দিলাম ঈশ্বরগঞ্জের উদ্দেশ্যে।
দু'ঘণ্টার মধ্যে পৌঁছে গেলাম ঈশ্বরগঞ্জে। বাসস্ট্যান্ডে নেমে সেখান থেকে একটা রিক্সা নিয়ে আধ ঘণ্টার লাগলো সাদিকের স্কুলে পৌছতে। ও সেখানকার একটা সরকারী প্রাইমারী স্কুলের শিক্ষক। আমি যাওয়াতে সাদিককে স্কুল থেকে ছুটি নিতে হলো। গ্রামের প্রাইমারী স্কুল তাই হুটহাট ছুটি নেওয়া কোন সমস্যা না।
হাঁটতে হাঁটতে আমরা চলে গেলাম সেই লোকটির বাড়িতে যে অদ্ভুত স্বপ্ন দেখে। আমার আসার কথা সাদিক তাকে আগেই বলে রেখেছিল।


লোকটির নাম রমজান মিয়া। অন্ধ, সেকথা তো আগেই বলেছি। বয়স আন্দাজ পঁয়তাল্লিশের আশেপাশে হবে। পরিবারের বড় ছেলে। মা-বাবা নেই। বিয়ে সাদি করেনি। একটা ছোট ভাই আছে রহমান। সে বিবাহিত। তার একটি ছেলে আছে। সে'ই বড় ভাইয়ের দেখাশোনা করে। রমজান লোকটি অন্ধ হলেও তার চলতে ফিরতে তেমন কোন অসুবিধা হয় না। ওইটুকু একটা ছোট্ট এলাকাতেই তো ঘুরছে ছোটবেলা থেকে তাই সবই ওর চেনা। একটা লাঠি হাতে নিয়ে সে সব যায়গায় ঘুরে বেড়ায়। এরওর বাড়িতে যায়, গল্পগুজব করে, বাজারে যায়, দোকানে বসে চা খায়।
কুশল বিনিময়ের পর রমজানকে জিজ্ঞেস করলাম - রমজান সাহেব আপনি কি ধরণের স্বপ্ন দেখেন?
মাথা নিচু করে চেয়ারে বসে থাকা রমজান উত্তর দিলেন - ভয়ংকর স্বপ্ন দেখি স্যার।
কি ধরণের ভয়ংকর স্বপ্ন?
ভয়ঙ্করভাবে মরে যাওয়ার স্বপ্ন স্যার। - রমজান সন্ত্রস্ত ভাবে উত্তর দিল।
জানতে চাইলাম - প্রথম কবে দেখলেন এরকম স্বপ্ন?
তা পরায় চার মাস আগে হবে।
হুম, প্রথম স্বপ্নটা আমাকে বলা যায়?
একটা নিঃশ্বাস নিয়ে রমজান শুরু করলেন - স্বপ্নখান দেখেছিলাম ভোরের দিকে। ভোর বুঝতে পারলাম কারণ স্বপ্নখান দেইখা যখন ধরফর করে উইঠা বসছি তার পরেই ফজরের আযান দিল। স্বপ্নে দেখলাম আমাদের বাজারের চা'র দোকানদার মনি মিয়া রাস্তায় হাটতেছে এমন সময় তার উপর দিয়া একটা টেরাক চইলা গেল। সইল্লের মাঝখানদিয়া গেছে টেরাকের চাক্কাগুলা। পেট-পিট সব থেঁতলাইয়া গেছে। মাটি ভিজা গেছে রক্তে। মনি মিয়ার সেকি চিৎকার। আসমান জমিন জানি এক হয়া যাবে সেই চিৎকারে।
 
অন্ধরা স্বপ্ন দেখা বলতে যা বোঝায় তা ঠিক আমাদের স্বপ্ন দেখার মত নয়। তাই রমজান স্বপ্ন দেখা বলতে ঠিক কি বুঝিয়েছে তা আমার কাছে পরিষ্কার হলো না। তাই জিজ্ঞেস করলাম - আপনি বলছেন আপনি ঘোটনাগুলো স্বপ্নে দেখেছেন। এই দেখে ব্যাপারটা ঠিক কেমন? নিশ্চয়ই আমাদের দেখার মতন নয়?
আপনেরা দেখা বলতে বুঝান কোন কিছুর অবয়ব দেখতে পারা আর আমাদের মতন অন্ধরা বুঝাই অবয়ব অনুভব করতে পারা। ব্যপারটা বুঝা অবশ্য আপনাদের জন্য কঠিন। রমজান বলে চললেন - আপনেরা যখন কোন কিছু দেখেন তখন তার বাইরের অবয়বটারে খুব বেশি গুরুত্ব দেন কারণ আপনাদের চোখ আছে আর বাদবাকি জিনিস যেমন - সেই বস্তুর গন্ধ, শব্দ, স্বাদ ,স্পর্শ এসবরে একটু কম গুরুত্ব দেন। কিন্তু আমাদের তো চোখ নাই তাই আমরা গন্ধ, শব্দ, স্বাদ ,স্পর্শ এসবরে বেশি গুরুত্ব দেই। আর বস্তুডারে ভালো মত অনুভব করার চেষ্টা করি। এই অনুভব করার বিষয়টা অবশ্য আপনেরা বুঝবেন না। খালি আপনেরা না যারা জন্মান্ধ না তারাও বুঝতে পারবে না।
এরকম বীভৎস স্বপ্ন তো অনেকেই দেখে। আমি বললাম। আপনার স্বপ্নকে আপনি কি ব্যতিক্রম মনে করছেন?
জি করতেছি। রামজান দাবী করলেন।
কেন? আমি আবার প্রশ্ন করলাম।
কারণ আমার স্বপ্ন শুধু দেখার মধ্যেই শেষ না। আমার স্বপ্ন সত্যি হয়।
মানে? অবাক হয়ে জানতে চাইলাম।
স্বপ্ন দেখে ঘুম ভেঙে যাওয়ার পর আমি ফজরের নামাজ পড়তে মসজিদে গেলাম। নামাজ শেষ করে মসজিদ থেকে বের হয়ে বাজারের দিকে রওয়া দিলাম। আমার সকাল সকাল বাজারে যাওয়ার অভ্যাস নাই। কিন্তু ওইদিন গেলাম। বাজারে পৌঁছানোর আগেই খবর পেয়েছি মনি মিয়া মারা গেছে। টেরাকের নিচে পড়ে মার গেছে। কথাগুলো বলতে বলতে রমজান যেন অতিতে হারিয়ে গেল।

কিছুক্ষণ ঘরের সবাই চুপ। এতক্ষণ সাদিক চুপচাপ আমাদের কথা শুনছিল এবার ও'ই নিরবতা ভাঙল। রমজানকে জিজ্ঞেস করল - এরপর আবার কবে এরকম স্বপ্ন দেখলেন?
প্রশ্নটা শুনে রমজান যেন অতিত থেকে ফিরলেন। মাথাটা হালকা একটু ঝাঁকিয়ে নিয়ে বললেন - মাসখানেক পরে হবে। দুপুরে খেয়েদেয়ে ঘুমাইছি। স্বপ্নে দেখলাম ফাতেমাবু মানে আমার মামাত বোন রান্না করতে গিয়া কারেন্ট লাইগা মারা গেছেন। ঘুম ভাংতেই রহমানরে ডাকলাম। বললাম বুবুর বাড়িতে কল দিয়া একটা খবর নিতে। ও কল দিয়া জানল আমার স্বপ্ন সত্যি হইছে।

আপনার এরকম স্বপ্নের কথা কে কে জানে? এই প্রশ্নটা করার তেমন কোন ইচ্ছা তখন আমার ছিল না। কিন্তু পর পর দুটো মর্মান্তিক ঘটনার কথা বলে দেখলাম লোকটা ভেঙে পড়েছে তাই প্রসঙ্গটা একটু ঘুরানোর জন্যে প্রশ্নটা করলাম।
বেশি কেউ না, আমার ছোট ভাই, তার বউ, সাদিক স্যার, আপনে আর কবিরাজ সাহেব। আমাদের গ্রামেরই কবিরাজ। নাম মফিজ আলি। 

ভদ্রলোক আর কিছু বলছেন না দেখে আমি আবারও প্রশ্ন করলাম - এরপর আরও স্বপ্ন দেখেছিলেন কি?
জি দেখেছি। রমজান বলল। গত দুই মাসে তিনবার একটা স্বপ্ন দেখেছি কিন্তু কেউ মারা যাই নাই।
কি দেখেছেন?
দেখি যে পানিতে ডুবে একটা লোক মারা যাইতেছে।
তিনটি স্বপ্ন কি হুবহু এক?
জি এক। তবে মারা না যাওয়ার ব্যাপারটা সম্ভবত কবিরাজ সাহেবের কেরামতি। দ্বিতীয় স্বপ্ন দেখার পর যখন ফাতেমাবু মারা গেলেন তারপরই কবিরাজ সাহেবকে গিয়া সব বললাম। উনি আমারে একটা তাবিজ দিলেন। বলে রমজান গলায় বাঁধা তাবিজটা দেখাল। দিয়ে বললেন ভয়ের কিছু নাই সব ঠিক হয়ে যাবে।  


তিন
রমজানের বাড়ি থেকে বিদায় নিয়ে আমরা চলে এলাম সাদিকের বাড়িতে। খুব বেশি দূরে না। পনের-বিশ মিনিটের হাঁটা পথ। পুরোটা দিন দুই বন্ধু আড্ডা দিয়ে কাটালাম। তারপর রাতটা থেকে সকালে বাসার উদ্দেশ্যে রওয়া দিলাম। এগারটার মধ্যেই বাসায় চলে এলাম বাসায়। 

বিকেলে ছাদে আমার ক্যাকটাসগুলোয় পানি দিচ্ছি এমন সময় ফোন বেজে উঠল। সাদিকের ফোন। ধরলাম। ওপাশ থেকে সাদিক জানাল - রমজান পুকুরে ডুবে মারা গেছে।   

শুক্রবার, ২২ মে, ২০২০

সাগরে আলাপ

- কিরে ঘটনা কি?
- কি জানি। কিছুই তো বুঝতে পারছি না।
- কাল শুনলাম নৌকায় দুই লোক কি সব আক্রমণ নিয়ে কথা বলছিল। কিসের জেন আক্রমণ হয়েছে।
- বলিস কি!
- হ্যাঁ। কিন্তু কিসের যে আক্রমণ সেটা ঠিক বুঝতে পারলাম না।
- তীরে মানুষের সংখ্যা নামমাত্র। জাহাজ-নৌকা সবই একেবারে কমে গেছে। কি হচ্ছে কিছুই তো বুঝতে পারছি না।
- যা হচ্ছে ভালোই হচ্ছে।
- একথা কেন বলছিস?
- কারণ এই যে আমরা তীরের এত কাছে ঘুরে বেরাচ্ছি এটা কিন্তু ছয়-সাত পুরুষ আগেই বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। কোনদিন ভেবেছিলি এত কাছ থেকে ডাঙা দেখতে পারবি?
- তা যা বলেছিস। পৃথিবী যেন আমাদের পাওনা অধিকার ফিরিয়ে দিচ্ছে।

[বঙ্গোপসাগরে দুই ডলফিনের মধ্যে কথা হচ্ছিল] 

সোমবার, ১৮ মে, ২০২০

সপথ

এই সপথ আগেও একাধিক বার করেছি, আজকেও করছি - "এখন থেকে নিয়মিত লিখব"।