মঙ্গলবার, ২২ জুলাই, ২০১৪

অতুলের গল্প(২) ~ জয়ন্ত ব্রহ্ম

মিঃ হাসেম একটি প্রাইভেট কম্পাণীতে চাকুরি করেন। বড় পদ তাই সেলারীটাও পান বেশ মোটা অংকের। ছোটবেলায় তিনি দারিদ্রতার কড়াল রুপ দেখতে পেয়েছিলেন বেশ ভালোভাবেই, তাই সবসময়ই তিনি চাইতেন তাকে অনেক বড় হতে হবে, পৌঁছাতে হবে উচ্চ থেকে উচ্চতার শেখড়ে।এখনো তিনি দুঃস্বপ্নে দেখেন সেই অনাহারে কষ্টে জর্জরীত হওয়া দিন গুলিকে। না খেতে পেয়ে হাড় গুলো পর্যন্ত বের হয়ে এসেছিলো চামড়ার উপর। তাঁর বাবা ছিলেন একজন জুয়ারী আর পাঁড় মাতাল। ছোট্র মুদির দোকান থেকে যা আয় হতো তার বেশির ভাগটাই নষ্ট করতেন জুয়া আর মদের পেছনে, আর রাতে বাড়ী ফিরে এসে মার উপরে চালাতেন অকথ্য নির্যাতন। মিঃ হাসেম কখোনই এর জন্য তার বাবাকে অনুতাপ করতে দেখেননি বরং মা যখন  মারখেয়ে ব্যাথায় চিৎকার করতেন তখন তার বাবা কি এক পৈশাচীক আনন্দে আরও বেশি করে তাঁর মাকে মেরে যেতেন যতক্ষননা তাঁর মা বেহুশ হয়ে যেতেন। তাঁর বাবার এরুপ ব্যবহারের কারণে পাড়ার প্রতিবেশিরা পর্যন্ত মুখ ফিরিয়ে নিয়ে ছিলো তাদের উপর থেকে। একদিন সকালে মাতাল অবস্থায় রাস্তা পার হতে গিয়ে গাড়ী চাপায় মারা পড়লেন বাবা তখন মিঃ হাসেমের বয়স মাত্র বার বছর। বাসায় খাবার নেই, এক মুঠো মুড়ী খাবার জন্যেও তাঁকে মানুষের দ্বারে দ্বারে ঘুরতে হয়।মা, যিনি ছিলেন মিঃ হাসেমের সর্বশেষ কাছের মানুষ তিনিও একদিন আর যাতনা সইতে না পেরে ফাঁস নিলেন সিলিংএর আড়কাঠ থেকে কাপড় ঝুলিয়ে। মিঃ হাসেম তখন বাইরে ছিলেন। যখন ঘরে ফিরলেন পেটে ক্ষুদা আর এক বুক অভিমান নিয়ে তাঁর ছোট দুটি হাত দিয়ে সিলিং থেকে ঝুলতে থাকা তাঁর মায়ের পা ‍দুখানি নিজের ছোট্র বুকে চেপে ধরে কেঁদে ছিলেন অনেকক্ষন।অবশেষে তাঁর কাছের এক আত্বিয় দয়া করে তাঁর ভরন পোষনের ভার নেন।ফ্যামিলিটা ভালোছিলো, তারাই একমাত্র তাঁদের বিপদের সময় সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতেন তাই এখানে মিঃ হাসেমের টিকে যেতে বিশেষ অসুবিধা হয়নি।স্কুল পারি দিয়ে একসময় কলেজ ও পরে বিশ্ব বিদ্যালয়ে ভর্তি হোন।
তিনি মেধবী ছিলেন তাই বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ চুকানোর পর ভালো একটা চাকুরী  যোগাতে তাঁর বিশেষ বেগ পেতে হয়নি।ভালো বেতন তাই ভালো একটি বাসায় স্যাটল হয়ে বিয়ে করলেন তিনি।তাদের দুই জনের একটি ছেলে সন্তানের জন্ম হলো, ছেলের নাম রাখা হলো অতুল। এক ছেলের পর মিঃ হাসেম আর বাচ্চা নিতে চান নি ওনার স্ত্রিরও তাতে মত ছিলো।স্বামীর অতিত তিনি জানতেন তাই তিনি কখনই চাইতেন না স্বামী যেন কোন কারণে কোনরকম কষ্ট পান।দিন যেতে থাকলো তার স্বাভাবিক নিয়মে। অতুলও আস্তে আস্তে বেড়ে উঠছে। এদিকে  মিঃ হাসেমও ভাল পজিসনে যাচ্ছেন। কম্পানীর সবাই তাঁকে খুব সম্মান করে।তাঁর একনিষ্ঠ প্রচেষ্টায় কম্পানীর অনেক উন্নতি হয়ে ছিলো আর আজকে তিনি নিজেই কম্পানীর এম.ডি। দুঃসময় আবার আঘাত হানলো মিঃ হাসেমের নিরঝনঝাট জীবনে।তিনি তার স্ত্রিকে হারালেন।তখন অতুল সবে মাত্র তেরয় পা দিয়েছে। মিঃহাসেম বুঝলেন চাইলেও তিনি ব্যস্ততার কারনে অতুলকে সময় দিতে পারবেন না।তাছারা একজন বাবা কি করেই বা মায়ের জায়গা নিতে পারে। দিন যেতে থাকলো কিন্তু মায়ের জন্য অতুলের কান্না বন্ধ হলো না।তিনি নিজেও চেষ্টা করে হাপিয়ে উঠেছেন।কিন্তু কোন লাভ হলো না, অতুল তার মাকে চায়। সবশেষে আর উপায়ন্ত না দেখে আবার বিয়ে করলেন তিনি।যাকে বিয়ে করলেন তার নাম সেলিনা খাতুন। ইনি খুব ভালো ঘরের ভালো পড়াশুনা জানা মেয়ে ছিলেন। তিনি প্রথম দিন থেকেই অতুলকে নিজের ছেলের মতন করে গ্রহন করে ছিলেন এবং একটা সময় তিনি অতুলকে এতটাই ভালোবেসে ফেলেন যে তিনি সিদ্ধান্ত নেন নিজে তিনি আর কোন বাচ্চা নেবেন না, অতুলই তার সব।এতে মিঃ হাসেম খুবই অভিবুত হয়ে ছিলেন এবং বুঝতে পেরে ছিলেন দ্বীতিয় বিয়ে করে তিনি কোন ভুল করেন নি।তিনি তার প্রথম স্ত্রিকে খুবই ভালো বাসতেন তাই দ্বীতিয় বিয়ে করতে হচ্ছে বলে তিনি অনুতপ্ত ছিলেন।এখন ভাবেন অতুলকে মানুষ করার জন্য এর কোন বিকল্প ছিলোনা। অতুল নষ্ট হয়ে যেত। কিন্তু মিঃ হাসেমের  সমস্ত আশা ভড়সাকে নষ্ট করে দিয়ে হঠাৎ করেই বদলে যেতে শুরু করলো অতুল। মিঃ হাসেম লক্ষ করলেন  কেন যেন অতুল তার সৎমাকে আর সহ্য করতে পারছে না, কেন যেন সে আর তাঁর ছায়াটাও আর দেখতে পারেনা।কেন যেন ওনার সমস্ত আদর, ভালবাসা, স্নেহ, মমতাকে তার কাছে কাটার মত মনে হতে লাগলো। মিঃ হাসেম খুব চিন্তিত হয়ে পরলেন। অনেক ভেবেও এরকম অসংখ্য কেনর জবাব তিনি খুঁজে বেড় করতে পারলেন না। শেষ পর্যন্ত মিসেস সেলিনাও কেঁদে কেটে অতুলের কাছে জবাব চেয়ে ছিলেন, কিন্তু সবই পন্ডশ্রম। অতুল এখন মায়ের সাথে তার বাবাকেও বিষ দৃষ্টিতে দেখে। একদিন মিঃ হাসেম আবিষ্কার করলেন তার ছেলে নিয়মিত নেষা করে বাইরে থেকে ঘরে ফিরছে। ছেলের প্রতি তিনি শেষে কঠোর হলেন, হাত খরচা কমিয়ে দিলেন। কিন্তু কিছুতেই কিছু হলোনা। যখন অতুলের বয়স উনিশ তখন সে রিতিমত একজন এডিক্ট একদিন নেশা করতে না পারলে চেচিয়ে সারাবাড়ি মাথায় তোলে। মিসেস সেলিনাও তাকে একা সামলে রাখতে পারেন না তাই কাজের সময়ও যখন তখন তাঁর স্বামীকে বিরক্ত করতে হয়।মিঃ হাসেম আর সহ্য করতে না পেরে শেষে অতুলকে রিহ্যাব সেন্টারে দিলেন। আশা করলেন ছেলে তার ভালো হয়ে ঘরে ফিরবে, ছেলেকে তিনি আবার আগের মত করে ফিরে পেতে চান তিনি। শতহোক একটি মাত্র ছেলে, দিন রাত তিনি আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করেন ছেলে যেন ভালো হয়ে ঘরে ফিরে আসে। কিন্তু ছয়মাসও গেলোনা মিঃ হাসেমের সমস্ত আশা ভরসাকে চুলোয় ফেলে রিহ্যাব সেন্টার থেকে পালাল অতুল। তবে পালিয়ে ঘরেই ফিরে আসলো আবার। মিসেস সেলিনা ছেলেকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ছিলেন অনেক, বাবা মিঃ হাসেমও। কিন্তু অতুল একটাও শব্দ করেনি, একটা কথাও বলেনি কারো সাথে। আবার নেশার জগতে পা রাখলো। শেষে আর কোন উপায় না বেরকরতে পেরে ছেলেকে আটকে রাখলেন ছাদের চিলেকোঠায়। মনে মনে সহস্র শাপ শাপান্ত দিলেন তাঁর মৃত বাবাকে যেন তিনিই অশরীরি হয়ে প্রতিশোধ নিচ্ছেন তার উপর, অতুলের উপর।তার শুখ, তার ছেলের শুখ যেন তাঁর আর সহ্য হচ্ছিলোনা কিছুতেই। অতুল বিশে পা দিলো। মিঃ হাসেম আশা করলেন এভাবে বন্ধ থাকলে অতুলের নেশাটা আস্তে আস্তে হয়তো বন্ধ হয়ে যেতেও পারে। তিনি সামনে আর কিছুই চিন্তা করতে পারছিলেন না, সবসময় ভয়ে অস্থির হয়ে থাকছিলেন অতুলের ভবিস্যৎ দিন গুলোর কথা চিন্তা করে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন