মঙ্গলবার, ২২ জুলাই, ২০১৪

অতুলের গল্প(৪) ~ জয়ন্ত ব্রহ্ম


সেদিন বিকেল বেলা…………
জীবনে প্রথমবারের মত নেশা করতে যাচ্ছে অতুল। এর আগে সে সিগারেট পর্যন্ত খায়নি। তার বাব বলতেন এধরনের জিনিস শরীরর জন্য ক্ষতির কারণ হয়ে দেখা দেয়, তাই সমবয়েসি অনেকেই এসব করলেও সে কখনো তা হাতে নিয়েও দেখেনি। তাই আজ তাকে মাদকের ধোওয়া টানতে হবে ভেবেই তার যেন কেমন লাগতে লাগলো, উত্তেজনায় বুক দুরু দুরু করছে। আস্তে করে সে তার সৎমায়ের চোখ ফাঁকি দিয়ে ছাদের চিলেকোঠায় চলে এলো এবং দরজা বন্ধ করে একটি একশো পাওয়ারের বাল্ব হাতে নিয়ে কাজ শুরু করলো। কাচের বাটি আনতে গেলে তাকে তার সৎমায়ের কাছে হাজারটা কৈফিয়ৎ দিতে হতো তাই সে বাল্ব ব্যবহারের কথা চিন্তা করে। সে বাল্বটিকে না ভেঙে তার ভেতরের সব জিনিস বাইরে বের করে আনলো, ব্যাস গোটা বাল্বটিই এখন একটি কাচের পাত্র। সে হাতে একটি ট্যাবলেট নিয়ে তার গন্ধ শুকলো কিন্তু তাতে সে কোন গন্ধ পেলোনা,  ট্যাবলেটটা দেখতে এক টাকার কয়েনের মত তবে আকারে আরও বড়। সে ট্যাবলেটটি একটি কাগজে মুড়ে তাতে হালকা ইটের বারি দিয়ে তা মিহি গুরো করলো। এবার সে গুরোটি বাল্বে ঢেলে বাল্বটির মুখ বন্ধ করে বাল্বটি একটি মোমের উপর ধরলো। আগুনের তাপে বেশ দ্রুতই গুরোটি বাষ্পে পরিনত হয়ে হালকা সাদা অথচ গাড় ধোঁওয়ায় পরিনত হচ্ছে।এক সময় পুরো বাল্বটি ধোঁওয়ায় ভরে গেলো, এখন শুধু অতুলকে তা বুক ভরে টেনে নিতে হবে। সাহসে ভর করে অতুল বাল্বটি মুখের কাছে এনে তাতে ছোট একটা টান দিল। জীবনে প্রথমবার, ধোঁওয়া তার গলা আর ফুসফুসে জ্বলন ধরিয়ে দিলো। তাড়াতাড়ি বাল্বের মুখে আঙ্গুল দিয়ে চোখমুখ বিকৃত করে ফেললো। ওফ্ কি জঘন্য শ্বাদ এর। এটুকুতেই যদি এ অবস্থা হয় তবে পুরোটা সে কি করে টানবে?।  হঠাৎ চোখ পরলো তার মায়ের ছবির উপর , দেখলো মা ছবি থেকে এক দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আছেন। দৃশ্যটা তার সমস্ত যন্ত্রনা ভুলিয়ে দিলো, যেমন করেই হোক তাকে পুরো বাল্বটি খালি করতে হবে মাকে কাছে পেতে হলে। এবার নিরদিধ্বায় অতুল বাল্বের সমস্ত ধোঁওয়া ফুসফুসে চালান করলো। এবার আর তার কোন কষ্ট অনুভব হলো না এমনকি নাক মুখ দিয়ে একটু ধোঁওয়াও বেড়হয়ে আসলো না।
তার ফুসফুস যেন ভোজবাজির মতই সমস্তটা হজম করে নিয়েছে বেমালুম। দুনিয়াটা চোখের সামনে যেন দুলতে শুরু করলো অতুলের, মাথা ঘুরতে লাগলো ভিষন ভাবে। মনে হলো মধ্যাকর্ষণ যেন তার সমস্ত শক্তি দিয়ে অতুলকে হিংস্র ভাবে মাটির সাথে পিষে ফেলবে এক নিমিশে। প্রচন্ড কষ্টে চোখদিয়ে পানি চলে এলো, এরই মাঝে মায়ের কথা মনে পরলো অতুলের। ইস মা যদি একবার তাকে কাছে টেনে আদর করতেন!। সময় জ্ঞানের হিসেব ভুলে গেলো অতুল। মনে হলো কোথায় যেন চলে যাচ্ছে সে। ওফ এত কষ্ট আর কতক্ষন সে সইবে? এখনো কেন মা  কাছে আসছেন না? তবেকি ছেলেটি তাকে মিথ্যা বলেছিলো ?  তাকেও আসলে তার মত এডিক্ট বানাতে চেয়েছিলো?। আর পারছেনা অতুল, যে কোন মুহুর্তে সব কিছু অন্ধকার হয়ে যাবে চোখের সামনে থেকে। শেষ বারের মতন মাকে পাশে দেখতে চাইলো অতুল কিন্তু কিছুই দেখতে পারলোনা। আস্তে আস্তে তার চোখ বন্ধ হয়ে আসলো। এভাবে ঠিক কতক্ষন গেলো বলা যায়না। মাথায় একটা কোমল স্পর্শ পেলো অতুল। এতো কোমল সে স্পর্শ যার টান কিছুতেই এড়ানো সম্ভব নয়। কানে গেলো নরম সুরে কেউ তার নাম ধরে ডাকছে।তার চুলে বিলি কেটে দিয়ে মধুর কন্ঠে কথা বলছে তার সাথে। অনেক কষ্ট হলো তার ছোখ খুলতে এবং যা দেখলো তাতে নিজের দুই চোখকে বিশ্বাস করতে পারলোনা। মা বসে আছেন তার মাথা নিজের কোলো তুলে নিয়ে।তার চুলে বিলি কেটে দিচ্ছেন, পিঠে হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন। তার মা, তার সত্যিকারের মা,  যাকে সে হারিয়ে ফেলেছিলো তার জীবন থেকে চিরদিনের জন্যই। অতুল আর থাকতে না পেরে তার মায়ের গলা জড়িয়ে ধরে হুহু করে কেঁদে ফেললো। এতো দিনের জমানো বুক ভরা অভিমান আর আবেগ যেন এভাবেই সে প্রকাশ করতে চায় তার সত্যি কারের মায়ের বুকে মাথা রেখে। আজ অতুলের সমস্ত প্রতিক্ষা শেষ হয়েছে। বিধাতার কাছ থেকে আজ সে ছিনিয়ে এনেছে তার মাকে। আজ এই পৃথিবীতে চাওয়ার বা পাওয়ার মত আর কিছুই অবশিষ্ট নেই তার। এক দৃষ্টিতে চেয়ে থাকলো অতুল তার মার অনিন্দ সুন্দর মুখটার দিকে।
 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন