রবিবার, ৮ জানুয়ারী, ২০১৭

মায়া সভ্যতা

মায়া’ পৃথীবির প্রাচীন সভ্যতা তথা ধর্ম সঙ্ককৃতির মধ্যে অন্যতম। যার সূচনাকাল খ্রিষ্টপূর্ব ২০০০ – ২৫০ অব্দ। এরা মেসোআমেরিকান একটি সভ্যতা। ‘মেসো’ গ্রিক শব্দ যার অর্থ মধ্য আর মেসোআমেরিকা বলতে বুঝায় মধ্য আমেরিকা মূলত মেক্সিকো। মেক্সিকান রাষ্ট্রগুলোর দক্ষিনে এবং বর্তমান গুয়াতেমালা, বেলিজ, এল সালভাডোর এবং পশ্চীমি হন্ডুরাসে এই সভ্যতা বিস্তার লাভ করে। খ্রিষ্টপূর্ব ২৫০ – ৯০০ অব্দ পর্যন্ত অনেক মায়া নগরীগুলো নানাদিক দিয়ে উন্নতি লাভ করে। ৯০০ শতক থেকেই এদের নগর সভ্যতা বিকাশ লাভ করে। উন্নতির শীর্ষে অবস্থানকালে মায়ানদের জনসংখ্যা ছিল প্রায় ২০ লাখ।এই সভ্যতাটি ছিল বিশ্বের সর্বাপেক্ষা ঘনবসতি এবং সাংস্কৃতিক ভাবে গতিশীল একটি সমাজ।


ভৌগলিক বিবরন:
মায়া অঞ্চলকে সাধারনভাবে তিন ভাগে ভাগ করা যায়:
১. দক্ষিন মায়া উচ্চভূমি: গুয়াতেমালা এবং চাপাস দক্ষিন মায়া উচ্চভূমির অন্তর্ভূক্ত,
২. দক্ষিন বা মধ্য মায় নিচুভূমি: মেক্সিকান রাষ্ট্রগুলো কাম্পেছ, কুইন্টানা রোও এবং উত্তর গুয়াতেমালা, বেলিজ এবং এল সালভাডোর দক্ষিন বা মধ্য মায়া নিচুভূমির অন্তর্ভুক্ত,
৩. উত্তর মায়া নিচুভূমি: ইয়ুকাটান উপদ্বীপ এবং পুউক পাহাড়গুলো উত্তর মায়া নিচুভুমির মধ্যে পড়ে।

ইতিহাস:
খ্রীষ্টপূর্ব ১০ম শতাব্দীর প্রথমদিক থেকে মায়া অঞ্চলে লোক বসবাস শুরু করেছিল। সূচনাটা মূলত গুয়াতেমালাতেই হয়েছিল। তারা শহর ভিত্তিক সাম্রাজ্য গঠন করে এবং বিস্তারও লাভ করেছিল। কৃষির দিক থেকেও এরা তীব্রভাবে বিকশিত ছিল। মায়নরা অন্যান্য মেসোআমেরিকান জাতিদের সাথে বাণিজ্যে অংশগ্রহন করতো। বাণিজ্যের প্রয়োজনে এরা মেক্সিকোর উপসাগরিয় কূল Tainos এর ক্যারিবীয় অঞ্চল পর্যন্তও যেত বলে জানা যায়। মায়ানরা কাকাও, লবণ, সাগর শেল, নানা ধরনের পাথর ও কাচের মত দেখতে কালো রঙের আগ্নেয় শিলার ব্যবসা করত।



৯ম শতকের দিকে মায়া কেন্দ্রগুলোর দক্ষিনের নিচু ভূমিগুলো বিশেষ করে গুয়েতেমালার মায়া নগরগুলি পরিত্যক্ত হয়ে যায়। এর পেছনের কারণগুলোকে দুইভাগে বিভক্ত করা যায়।
১. প্রাকৃতিক কারন: অত্যাধিক জনসংখ্যা বৃদ্ধি, বিদেশী আক্রমন, কৃষকদের বিদ্রোহ এবং বানিজ্য পথের পরিবর্ন বা ভেঙেপড়া,
২. প্রাকৃতিক কারন: পরিবেশ সংক্রান্ত বিপর্যয়, সংক্রামক রোগ, এবং জলবায়ু পরিবর্তন।
ষোড়শ শতকে মায়নরা স্পেনিশদের দ্বারা আক্রন্ত হয়। তার পর থেকে প্রায় ১৭০ বছর নানা লড়াই আর সংঘর্ষের মধ্য দিয়ে স্পেনিশদেরকে সস্পুর্ন মায়ান অঞ্চল নিয়ন্ত্রনে নিতে হয়েছে।

স্থাপত্য:
মায়ানদের স্থাপত্যের মধ্যে ছিল ধর্মিয় সৃতিসৌধ, মন্দির, বসতবাড়ী ইত্যাদি। বাড়ীগুলো মূলত শহরের বাইরেই বেশি হতো কারন মায়ানরা ছিল কৃষি নির্ভর। তারা পিরামিডের মতো দেখতে উপাসনাগৃহ ও উৎসবস্থল তৈরি করেছিল। এগুলো ছিল তাদের ধর্মীয় ও রাজনৈতিক জীবনের কেন্দ্রবিন্দু। মায়াদের ৪টি প্রধান কেন্দ্র ও অনেকগুলো ছোট ছোট কেন্দ্র ছিল। প্রধান কেন্দ্রগুলোর একেকটি থেকে দেশের প্রায় এক চতুর্থাংশ এলাকায় শাসনকার্য চালানো হত।



শিল্পকর্ম:
অনেকে গবেষক মনে করে থাকেন যে প্রাচীন যুগের শিল্প গুলোর মধ্যে মায়ানদের তৈরি শিল্পকর্গুলো সবচেয়ে সুন্দর। মায়ানদের শিল্পকর্মের মধ্যে রয়েছে কারুকাজময় মন্দির, সৃতিসৌধ ও বাড়ীঘড়।কারুকাজের বিষয়বস্তু – গায়ক, নর্তকী, মায়ান মহিলারা, উৎসবে ধর্মযাজকরা, যুদ্ধ, মুখোস, দেবতা ইত্যাদি।



গনিত ও জ্যোর্তিশাত্র:
এই দুইটি বিষয়ে মায়ানদের জ্ঞন ছিল অভূতপূর্ব। গণিতে শূন্যের ব্যবহার, পজিশনাল নোটেশন নির্ধারণ করেছিল মায়ারা। তারা ২০ ভিত্তি সংখ্য ও ৫ ভিত্তি সংখ্যা পদ্ধতি ব্যবহার করতো। তারা বিশাল-বিশাল গাণিতিক হিসাব করতে পারতো। জ্যোর্তিশাস্ত্রে সৌর বৎসরের গননা, চন্দ্র ও শুক্র গ্রহের অবস্থান এমনকী সূর্যগ্রহনও আগেভাবে বলে দিতে পারত তারা!

সময়:
সময় নিয়ে মায়ানদের ভাবনা চিন্ত ছিল যথেষ্ট নির্ভুল ও নিয়মিত। অতীতের একটি অপরিবর্তনীয় বিন্দু থেকে মায়ার ইতিহাস গণনা করা হতো। যেমন-খ্রীষ্টান ধর্মের খেত্রে যিশুর জন্ম, গ্রিসের খেত্রে প্রথম অলিম্পিক ইত্যাদি। তাদের বর্ষ পঞ্জিকার একটি নির্দিষ্ট তারিখকে (৩১১৪ খ্রীষ্টপূর্বাব্দের) কেন্দ্র হিসেবে ধরে নিয়ে তারা সময়ের হিসেব করতো।

বর্ষপঞ্জিকা:
K’in হল মায়া বর্ষপঞ্জিকার একটি সময় যা একটি দিনের অনুরুপ, উইনাল হল মাস যা ২০ দিনে সম্পন্ন হতো আর ১৯ উইনালে হতো ১ হাব বা বছর যা ৩৬০ দিন বুঝায়। এর সাথে যুক্ত করা হয় ওয়েব নামক ৫ দিনের একটি মাস যাকে মায়ানরা খুব অমঙ্গলজনক মনে করতো। মায়ানদের মাসের নাসগুলো হচ্ছে -
১) Pop (মাদুর)
২) Wo (কাল যুক্তাক্ষর)
৩) Sip (লাল যুক্তাক্ষর)
৪) Sotz (বাদুড়)
৫) Sek (?)
৬) Xul (কুকুর)
৭) Yaxk’in (নতুন সূর্য)
৮) Mol (জল)
৯) Ch’en (কাল ঝড়)
১০) Yax (সবুজ ঝড়)
১১) Sak (সাদা ঝড়)
১২) Keh (লাল ঝড়)
১৩) Mak (পরিবেষ্টিত)
১৪) K’ank’in (হলদে সূর্য)
১৫) Muwan (পেঁচা)
১৬) Pax (গাছ লাগানোর সময়)
১৭) K’ayab (কচ্ছপ)
১৮ )Kumk’u (শস্যভান্ডার)
১৯) Wayeb (অমঙ্গলজনক ৫ দিন)

তাছাড়া মায়ানদের ধর্মভিত্তিক বর্ষপঞ্জিকাও (Tzalkin) ছিল। এতে ২০ দিনে হতো ১ মাস, ১৩ মাসে হতো ১ বছর, ৫২ বছরে হতো ১ শতাব্দী। প্রতি ৫২ বছর পর পর ধর্মমাসের এবং সাধারন মাসের একই নামের দিনটিতে মায়ানরা বিপুল আয়োজনে উৎসব পালন করতো তখন নরবলির মাত্রও বৃদ্ধি পেতো।

লিখনপদ্ধতি:
খ্রীষ্টপূর্ব ২০০-৩০০ শতাব্দীতে মায়ানরা লিখতে শুরু করে। তাদের প্রতিটি চিহ্য বা বর্ন এক একটি শব্দ বা অর্থের প্রকাশ করতো।
লিখার জন্য ময়ানরা ব্যবহার করতো পশুর চুল বা লোম দ্বারা তৈরি তুলী, পাখির পালক দ্বারা তৈরি কলম। মায়া সমাজের সবাই লিখতে পারতো না তাই লেখকদের একটা গুরুত্বপূর্ন অবস্থান ছিল।

ধর্ম:
মায়ারা একটি সময়ের চক্র প্রকৃতিতে বিশ্বাস করতো। মায়া ধর্মযাজকদের কাজ ছিল এই চক্রগুলি ব্যাখ্যা করা এবং তাদের সমস্ত বর্ষপঞ্জিকার সংখ্যার সম্পর্কে একটি দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি করা।
ধর্মিয় বর্ষপঞ্জিকার শুরু হতো আইমিক্র (Imix) এক দানবের পুজার মাধ্যমে। দেবতাদের মধ্যে ছিল আইক (IK) নামের বায়ু দেবতা, চিচ্ছেন (Chicchans) নামের সর্প দেবতা। এছাড়াও তারা আরো নানা দেব-দেবীতে বিশ্বাস করতো।
মায়ানরা বিশ্বাস করতো ১৩ জন দেবদেবীর মধ্যে ৬ জন সূর্যকে উদীত করতো আর ৬ জন সূর্যকে নামিয়ে আনতো, ১ জন কিছু সময়ের জন্য সূর্যকে মধ্য গগনে ধরে রাখতো। পৃথীবির অন্তঃপুরে জিবালবা (Xibalba) নামক স্থানে মৃতরা বসবাস করতো। ৪ স্তরের সেই স্থানটি ছিল খুব কষ্টের যা পাহারা দিতো ৯ জন দেবদেবী। প্রতি রাতেই সূর্য জাগুয়ারের বেশে অন্ধকার সেই জগৎ অতিক্রম করতো আর চার স্তর অতিক্রম করার পর পূর্ব দিগন্তে উদিত হতো।
সূর্যোদয়কে মায়ানরা সর্গ দর্শন বলেই মনে করতো। তাই তারা সূর্যেরো আরাধনা করতো।
তাদের মন্দিরে ব্যপক আয়োজনের সাথে পূজা পালন করা হতো। নিয়মের মধ্যে ছিল – বাধ্যতামূলক উপবাস, যৌনকর্ম হতে বিরত থাকা, গরম জলে স্নান ইত্যাদি। ধর্মমন্দিরে রাজা্-রানী আপন যৌনাঙ্গ অথবা নাসিকা হতে রক্ত উৎসর্গ করতেন। দেবদেবীর সন্তুষ্টির জন্য নানা প্রকার খাদ্য, পশু ও মানুষের হৃদপিন্ড উৎসর্গ করতো।



কৃষি:
শুরু থেকেই মায়ানরা ছিল কৃষি প্রধান। নিজেরাই নিজেদের খাদ্যের যোগান দিতো এবং প্রয়োজনে বিনিময় প্রথারো আশ্যয় নিতো। তারা ভুট্রা, সূর্যমুখী বীজ, তুলা ও অন্যান্য ফসল চাস করতো।

বর্তমানে মায়ানরা:
স্পেনিস আক্রমনের পর থেকেই মায়ানরা ধিরে ধিরে খ্রীষ্ট ধর্মে দিক্ষিত হতে থাকে। মায়ারা আজও আছে। দক্ষিণ মেক্সিাকোয়, গুয়েতেমালায় ও বেলিজে।



কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন