বলবো না
তখন সবে হাই স্কুলে পা দিয়েছি। শীতের মধ্যে সকাল সকাল লেপের নিচ থেকে উঠতে কি যে কষ্ট হতো। হাতমুখ ধোয়ার জন্যে পুকুরের সামনে দাঁড়াতেই মনে হতো ঝেড়ে একটা দৌড় দিয়ে আবার লেপের মধ্যে গিয়ে ঢুকি। অবশ্য মায়ের রুদ্রমূর্তিটা মনে পড়ত বলে তেমনটা করা হতো না কখনোই।
গরম ভাতের সাথে কোন দিন বর্তা, কোন দিন ভাঁজি অথবা ডাল এই দিয়ে খেয়েদেয়ে তৈরি হয়ে বেরিয়ে পড়তাম স্কুলের জন্যে। ঈদগার কাছাকাছি এসে সবার সাথেই দেখা হতো। তারপর পাখির মত দল বেঁধে আনন্দগুলো ভাগাভাগি করে কাটিয়ে দিতাম সারাটা দিন। এটাই যেন নিয়ম হয়ে গিয়েছিল আমাদের। কিন্তু নিয়ম তো ভাঙার জন্যেই।
একদিন সকালের কথা। ঘুম ভাংতেই দেখি মা বাবার মাথার কাছে কপালে হাত দিয়ে বসে কাঁদছে। বাবা শুয়ে আছে। মাঝে মাঝে কোকীয়ে উঠছে, ব্যথায়। তখন হাঁটুগুলো অনেকটা ভাজ করে উপরে নিয়ে আসছে, কুচকে ফেলছে চোখ, দু’হাত দিয়ে খামছে ধরছে পেট। আমি বুঝতে পারলাম ব্যথাটা পেটে।
ধীরে ধীরে বাবা কিছুটা শান্ত হয়ে এলো। মা উঠে গেল পাশের ঘরে। আমি পাশেই বসে ছিলাম। হঠাৎ বাবা বালিশ থেকে মাথাটা একটু তুলে বলল – ‘গায়ে কোথাও পচন ধরলে কেমন লাগে জানিস?’ আমি এমন প্রশ্ন কোনদিন শুনিনি। জিজ্ঞেস করলাম – ‘কেমন লাগে বাবা?’ বাবা ছলছল করা চোখ নিয়েও মুচকি হেসে বলল – ‘বলবো না’।
তার কিছুদিন পর, আমি তখন আর স্কুলে যাই না সারাদিন বাবার পাশেই বসে থাকি। বাবা সারাদিন শুয়ে থাকে, কখনো গলা দিয়ে গড়গড় শব্দ করে নিজেই জেগে উঠে কাশতে শুরু করে, মা পাশ থেকে গরম পানির গ্লাসটা এগিয়ে দেয়। আমি পাশে বসে থাকি। বাবাকে চামচ দিয়ে জাও খাইয়ে দেওয়া হয়, আমি পাশে বসে থাকি। নিয়মিত মানুষের আনাগোনা হয় বাড়িতে, আমি পাশে বসে থাকি। কখনো কখনো বাবা পেটটা খামছে ধরে চিৎকার করে ওঠে ব্যথায়, মা বাবাকে জাপতে ধরে মাথাটা বুকের কাছে নিয়ে ফুঁপিয়ে ওঠে, আমি কেঁদে উঠি।
একদিন বাড়িটা খুব বেশি নিরব হয়ে গেল। মা একটু পর পর ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠছে, সাথে কিছু নিকটাত্মীয়রাও। কেউ কেউ দোয়া পড়ছে। এত মানুষ তবুও বেশি আওয়াজ নেই বাড়িটায়। বাবা আজ চিৎকার করছে না, শুধু একটানা গুঙিয়ে চলেছে। গড়গড় আওয়াজ হচ্ছে গলা থেকে। একটু পর পর মুখের ভেতরটা রক্তে ভোরে উঠছে, যখন উপচে পড়ছে গাল বেয়ে তখন মুছিয়ে দিচ্ছে কেউ। আমি পাশে বসে আছি।
সেদিন সন্ধ্যায় যখন গ্রামটা নিয়মমাফিক নীরব হয়ে গেল, বাবার প্রিয় পূর্ণিমার চাঁদটা যখন তার সবটুকু আলো ঢেলে দিচ্ছিল আমাদের গ্রামে তখন কি হয়েছিল জানো?
বলবো না।
গরম ভাতের সাথে কোন দিন বর্তা, কোন দিন ভাঁজি অথবা ডাল এই দিয়ে খেয়েদেয়ে তৈরি হয়ে বেরিয়ে পড়তাম স্কুলের জন্যে। ঈদগার কাছাকাছি এসে সবার সাথেই দেখা হতো। তারপর পাখির মত দল বেঁধে আনন্দগুলো ভাগাভাগি করে কাটিয়ে দিতাম সারাটা দিন। এটাই যেন নিয়ম হয়ে গিয়েছিল আমাদের। কিন্তু নিয়ম তো ভাঙার জন্যেই।
একদিন সকালের কথা। ঘুম ভাংতেই দেখি মা বাবার মাথার কাছে কপালে হাত দিয়ে বসে কাঁদছে। বাবা শুয়ে আছে। মাঝে মাঝে কোকীয়ে উঠছে, ব্যথায়। তখন হাঁটুগুলো অনেকটা ভাজ করে উপরে নিয়ে আসছে, কুচকে ফেলছে চোখ, দু’হাত দিয়ে খামছে ধরছে পেট। আমি বুঝতে পারলাম ব্যথাটা পেটে।
ধীরে ধীরে বাবা কিছুটা শান্ত হয়ে এলো। মা উঠে গেল পাশের ঘরে। আমি পাশেই বসে ছিলাম। হঠাৎ বাবা বালিশ থেকে মাথাটা একটু তুলে বলল – ‘গায়ে কোথাও পচন ধরলে কেমন লাগে জানিস?’ আমি এমন প্রশ্ন কোনদিন শুনিনি। জিজ্ঞেস করলাম – ‘কেমন লাগে বাবা?’ বাবা ছলছল করা চোখ নিয়েও মুচকি হেসে বলল – ‘বলবো না’।
তার কিছুদিন পর, আমি তখন আর স্কুলে যাই না সারাদিন বাবার পাশেই বসে থাকি। বাবা সারাদিন শুয়ে থাকে, কখনো গলা দিয়ে গড়গড় শব্দ করে নিজেই জেগে উঠে কাশতে শুরু করে, মা পাশ থেকে গরম পানির গ্লাসটা এগিয়ে দেয়। আমি পাশে বসে থাকি। বাবাকে চামচ দিয়ে জাও খাইয়ে দেওয়া হয়, আমি পাশে বসে থাকি। নিয়মিত মানুষের আনাগোনা হয় বাড়িতে, আমি পাশে বসে থাকি। কখনো কখনো বাবা পেটটা খামছে ধরে চিৎকার করে ওঠে ব্যথায়, মা বাবাকে জাপতে ধরে মাথাটা বুকের কাছে নিয়ে ফুঁপিয়ে ওঠে, আমি কেঁদে উঠি।
একদিন বাড়িটা খুব বেশি নিরব হয়ে গেল। মা একটু পর পর ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠছে, সাথে কিছু নিকটাত্মীয়রাও। কেউ কেউ দোয়া পড়ছে। এত মানুষ তবুও বেশি আওয়াজ নেই বাড়িটায়। বাবা আজ চিৎকার করছে না, শুধু একটানা গুঙিয়ে চলেছে। গড়গড় আওয়াজ হচ্ছে গলা থেকে। একটু পর পর মুখের ভেতরটা রক্তে ভোরে উঠছে, যখন উপচে পড়ছে গাল বেয়ে তখন মুছিয়ে দিচ্ছে কেউ। আমি পাশে বসে আছি।
সেদিন সন্ধ্যায় যখন গ্রামটা নিয়মমাফিক নীরব হয়ে গেল, বাবার প্রিয় পূর্ণিমার চাঁদটা যখন তার সবটুকু আলো ঢেলে দিচ্ছিল আমাদের গ্রামে তখন কি হয়েছিল জানো?
বলবো না।
Comments
Post a Comment